গভীর রাত। দূরপাল্লার ট্রেন। স্লিপার কোচের নীচের বার্থে সিট। ঘুম ভেঙে গেল। জানি না কত রাত। ঘড়ি দেখতে ইচ্ছা করল না। থাক। রাত তো রাত। কত রাত জেনে তো দরকার নেই।
একটা অজানা স্টেশানে গাড়ি দাঁড়িয়ে। কয়েকজন চাওয়ালা এই এত রাতেও, মনকে এক মোচড়ে ঘরছাড়া করা সেই বিশেষ সুরে জানলায় জানলায় ডেকে যাচ্ছে - চায়ে... চায়ে......
কোচের মধ্যে কিছু নাক ডাকার আওয়াজ আর পাখার যান্ত্রিক শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই।
মনটা ঘুমের ঘোর পুরোপুরি ছেড়ে, পাখা ঝাপটিয়ে স্টেশানে এসে বসল। দুটো চোখে যতদূর দেখা যায় দেখছি। উড়িষ্যার কোনো নাম না জানা স্টেশান। মফঃস্বলের মত কোনো জায়গা দেখে মনে হচ্ছে।
প্ল্যাটফর্মের উপর সার দিয়ে শুয়ে বেশ কিছু মানুষ। বাচ্চাগুলো মায়ের বুকের কাছে ঘেঁষে। কয়েকটা কুকুর অদূরে শরীরটাকে গুটিয়ে ঘুমিয়ে। প্ল্যাটফর্মের পাশ দিয়ে ওঠা একটা বিরাট বড় অশ্বত্থগাছ। তার গোড়া থেকে অর্ধেক প্ল্যাটফর্মের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। বাকিটা অন্ধকার আকাশের সাথে মিশে।
প্ল্যাটফর্মে একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল। ধড়মড় করে উঠলেন একজন শীর্ণদেহ মহিলা - বাচ্চাটার মা। বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে, বাচ্চাটার মুখটা নিজের আঁচলের তলায় নিয়ে নিলেন। বাচ্চাটার কান্না থেমে গেল। মহিলার চোখ বন্ধ, মুখে জড়ানো ঘুম। মাথাটা বুকের কাছে থেকে থেকেই ঝুঁকে পড়ছে পাথর গড়িয়ে পড়ার মত আচমকাই। তিনি চমকিয়ে সজাগ হওয়ার চেষ্টা করেই আবার ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছেন।
দূরে রাস্তা দিয়ে দু-একটা মোটর সাইকেল গেল। পিছনে পিছনে একটা অ্যাম্বুলেন্স আলো জ্বেলে নিঃশব্দে। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। কয়েকটা কুকুর আলস্যে ডেকেই আবার শুয়ে পড়ল। অ্যাম্বুলেন্সের আলো যতদূর দেখা যায় তাকিয়ে রইলাম। কে একজন উপরের বার্থ থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, দাদা কোন স্টেশান?
চমক ভাঙল। বললাম, জানি না দাদা, চশমা পরিনি।
অ - বলে তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। সামনের সেই মা আর শিশু আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। বাচ্চাটা কোলের সাথে মিশে। আচমকাই একজন বুড়ীমানুষ জানলার কাছে এসে হাত বাড়ালেন। শতচ্ছিন্ন পোশাক। টাকার ব্যাগটা নিতে উঠব, ইতিমধ্যে একজন আরপিএফ এসে তাকে ধমকে তাড়াল। এরকম সাধারণত হয় না, বুঝলাম না কেন। তবে ওনার চালচলনে মনে হল উনি মানসিকভাবে সুস্থ নন।
ট্রেন সংকেত জানাল ছাড়ার। দুটো চোখ বিস্ফারিত করে তাকিয়ে আছি এই ক্ষণিক দেখা সংসারটার দিকে। ট্রেন দুলে উঠল। ঘটাং ঘটাং ছান্দিক শব্দের সাথে একটু একটু করে স্টেশানটা সরে যেতে লাগল চোখের সামনে থেকে। হঠাৎ দেখি সেই বুড়ি স্টেশানে গাছ ঘেরা সিমেন্টের চাতালে মাথা ঠুকে ঠুকে চীৎকার করে কি বলছে আর কাঁদছে। ভাষাটা বুঝলাম না। তবে ওর গগনভেদী আর্তরবে আমার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল, কার উপর এত আক্রোশ, এত অভিমান ওর! এভাবেই ওর জীবনটা শেষ হবে?! আমার কান্না পেল। সেই অ্যাম্বুলেন্সের আলোটা মনে পড়ল। কি হল এত রাতে কার? কোনোদিনও জানতে পারব না। স্টেশান ছাড়িয়ে ট্রেনটা লোকালয়ের পরিধি ছুঁয়ে ছুটছে। রাস্তার আলোগুলো সার দিয়ে জ্বলছে। ফাঁকা ফাঁকা রাস্তা। অসংখ্য ঘুমন্ত বাড়ি। এ আধা শহরের কাউকে আমি চিনি না, তবু যেন চিনি। ওরাও আমায় চেনে।
চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। জানলা দিয়ে দেখছি তারাভরা অসীম শান্ত আকাশ। পোলগুলো পার না হলে মনেই হবে না ট্রেনটা আদৌ যাচ্ছে। তারা স্থির, আকাশ স্থির, আমার দৃষ্টিও স্থির।
এরকম কত অজানা শহর গ্রাম ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছুটে চলেছি সারাটা জীবন। এইটুকু সময়ের ওই প্ল্যাটফর্মটুকু মনের কোণায় কেমন আটকে থাকল কি করূণ মায়ায়। এত বড় সংসার। ক'টা মানুষের কাছাকাছি আসা সম্ভব সারাটা জীবনে? কত কথা, কত ব্যাথা, কত সুখ, কত স্বপ্ন, কত আশা অজানা থেকে যাবে, জানি। ভালোবাসার চাইতে বড় অর্থ জীবনের কেন্দ্রে আর কিছু কোনোদিন কেউ পাবে বলে বিশ্বাস হয় না। যতটুকু ভালোবাসতে পেরেছি, ভালোবেসে আঘাত সহ্য করতে পেরেছি, ভালোবেসেই আত্মাভিমানকে জলাঞ্জলি দিয়ে কাউকে আপন করতে পেরেছি - ততটুকুই সার্থক বাঁচা। বাকিটা শুধুই বায়োলজিকাল বাঁচা, অর্থহীন। এ ভালোবাসা না থাকলে এতবড় আকাশটা, পৃথিবীটা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেত আমার হৃদয়ের সাড়া না পেয়ে। এতবড় ক্ষতি বিধাতার সইত কি?