মশারির চারদিকটা ভাল করে গোঁজা হল কিনা দেখতে দেখতে ওনার বেশ কিছুটা সময় কেটে যায়। মাথার কাছে টর্চ, জলের বোতল নিয়ে যখন বিছানায় ঢোকেন, মনে হয় এ যেন তার রাতের সংসার। একা মানুষটা কাটাল দোকা ভাবে সাঁইত্রিশ বছর। তারপর হঠাৎ এখন একা। নিঃসন্তান বলে না, দুর সন্তান বলে। বাইরের দূরত্ব না, ভিতরে।
এত ঘনভাবে চাদরের নীচে মশারিটা গোঁজেন বলেই কি ঘুমও ঢুকতে পারে না!? এটা যদিও কোনো কাজের কথা না, তবু ওনার মনে হয়। মাঝে কয়েকদিন মশারি ছাড়া শুতে চেষ্টা করেছেন। পারেন নি। কেমন একটা নিরাপত্তাহীন লেগেছে। কিসের ভয়? জানেন না স্পষ্ট করে।
আর স্পষ্ট করে বোঝার দিনও যদিও নেই। যা বোঝেন, একটাই কথা বোঝেন। ভালোবাসা নেই। একটা চুক্তি আছে। সবসময় সব চুক্তি সফল হয় না, তাই সব ভালোবাসাও হয় না। তবে যে এত মহাপুরুষেরা বলে গেলেন? নেই বলেই কি এত করে বলে গেলেন, যেমন ঈশ্বরের কথা বলেন এত করে?
উঠে ছাদে আসলেন। আকাশ ভর্তি তারা। অকারণ এসব? নাকি শুধু একটা অ্যাক্সিডেন্ট। যা ঘটছে চারদিক, সবই? জানেন না।
আত্মহত্যার কথা ভাবতেন খুব একটা সময়ে। এখন জানেন উনি একা নন। সবাই পা পুড়িয়ে হাঁটছে। আচ্ছা এই সবাইটা কে? তাকে কেমন দেখতে?
ভোর হচ্ছে। সবার ভোর হচ্ছে। সবাই জাগছে। ওই তো রবীনের ছেলেটা উঠানে নামল। ওই রমেশবাবু চা খেতে আসার জন্য ইতস্তত করছেন। গরীব মানুষটার খুব চায়ের শখ। সেটা ইনিই মিটিয়ে দেন। অন্যদিন একটু বিরক্তও লাগে মাঝে মাঝে। মনে হয় যেন প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এখন মনে হল না।
উনি ডাকলেন, রমেশবাবু!
রমেশবাবু চা খেয়ে চলে গেলেন। উনি ইজিচেয়ারে বসে ভাবলেন, এই 'সব' বা 'সবার' কথাটার অর্থ সঠিক কি? কতজন মানুষ মিলে 'সবাই' হয়? সব যায়। কিন্তু এই সবাইয়ের টানটা যায় না। একদল গেলে আরেক দল এসে জায়গা করে নেয়। এই যে সামনের গাছটায় সব নতুন পাতা। এক নতুন দল।
তিনি খেয়াল করলেন, তার বুকের মধ্যে একটা কুলকুল শব্দ পাচ্ছেন। যেন মরা খাতে সরু স্রোত জন্মাচ্ছে। ভালবাসার স্রোত। চুক্তির মত ভালোবাসা না। ওই কচি পাতাগুলোর মত ভালোবাসা।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। অনেকদিন হাঁটতে বেরোননি। আজ বেরোবেন। লাঠিটা নিলেন। দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। বাগানের গেটটা বন্ধ করতে করতে মনে হল, কে যেন হাতে হাত রাখল। পা বাড়ালেন ধীরে। সাড়া যে দিতেই হবে।
ওনার মনটা হঠাৎ ভাল লাগতে লাগল। অকারণে। সবার মত। বুকের মধ্যে সেই ক্ষীণ স্রোতটা কখন জানি একটা দীঘি তৈরি করে ফেলেছে। সবার দীঘি। গেট আটকিয়ে লাভ নেই। খোলাই থাক। ফুসফুসের দরজা আর মনের দরজা বন্ধ হলেই মরণ। আগে দীঘিটা শুকায়। পরে মানুষটা।