Skip to main content
 
 
       লোকটার গ্রামটা ছিল সমুদ্রমুখী। তার একটা কারখানা ছিল। তার তিনটে শোয়ার ঘর, দুটো রান্নাঘর আর চারটে বসার ঘরওয়ালা বাড়ি ছিল। উঠোনে মুরগী ঘুরত। ছাগল ঘুরত। গরু ঘুরত। কিন্তু লোকটা নিরামিষাশী ছিল। লোকটার একটাই সাধ রকেট বানানো। সে শহরে গিয়ে রকেট বানানো শিখে এসেছিল। রকেট বাজি। সত্যি রকেট না। কারণ সে কোনোদিন মহাকাশে যেতে চাইত না। উঠোনে শুয়ে তারা দেখতেই ভালো লাগত তার। তারাদের কাছে গিয়ে উঠোন দেখতে কোনোদিন ইচ্ছা জাগেনি। 
       কিন্তু তার বানানো কোনো রকেট একটা বড় নারকেল গাছের বেশি উড়ত না। প্রচণ্ড শব্দ করে ধোঁয়া উড়িয়ে গ্রামের কিছুটা উপরে গিয়েই ভুস্ করে নিভে যেত। আগে লোকেরা খুব ভিড় করে দেখতে আসত। এমনকি বর্ষাকালে রকেট উড়াবে বলে সে নিজের কারখানার মাথায় একটা গর্তও করেছিল। লোকেরা প্রতিমাসের একাদশীর দিন সন্ধ্যেতে বর্ষাকালে ছাতা মাথায় দিয়ে যে যার উঠোনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত কখন আয়াপ্পা রকেট উড়াবে। ঠিক সাতটা তেইশে রকেটটা উড়ে কিছুদূর উঠেই ভুস্ করে নিভে যেত।
       আয়াপ্পার বয়েস এখন পঞ্চান্ন বছর চার মাস তিনদিন। তার একটা রকেটও নারকেল গাছের বেশি ওড়েনি। তার একটাই ইচ্ছা তাদের গ্রামের মাথায় যে দুটো নীল তারা জ্বলজ্বল করে তাদের মধ্যে দিয়ে রকেটটা উড়ে মিলিয়ে যাক। এই কথাটা সে গ্রামের প্রধান পুণ্ডুরী আম্মাকে বলেছে। পুণ্ডুরী আম্মার বান্ধবীর ছেলে আয়াপ্পা। সে দুই চোখ জল কাজলের বাঁধে আটকে বলেছে, আচ্ছা আচ্ছা আচ্ছা, তাই হবে। তারপর পুণ্ডুরী নিজের বরকে বলে কোচি থেকে একটা পিতলের মেডেল কিনে আনিয়ে রেখেছে। যেদিন দুটো তারার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে যাবে আয়াপ্পার রকেট সেদিন এই মেডেলটা তাকে পরিয়ে দেওয়া হবে। সেদিন গ্রামের স্কুল ছুটি দেওয়া হবে। মেয়েরা সাজবে। ছেলেরা বাইচ খেলবে। বুড়োবুড়িরা তাদের যৌবনের গানগুলো, যা এখনকার ছেলেমেয়েরা গাইতে জানে না, সেগুলো গাইবে। প্রতিটা বাড়ির সামনে নতুন ডিজাইনের আলপনা দেওয়া হবে। সে নতুন ডিজাইনের আলপনার বইও পুণ্ডুরী আম্মা চেন্নাই থেকে নিজের ভাইয়ের বউকে দিয়ে আনিয়ে রেখেছে।
       সবই ঠিক ছিল। কিন্তু আয়াপ্পার রকেটটাই উঠল না একটা নারকেল গাছের মাথার বেশি। পুণ্ডুরী আম্মার চোখ চিরকালের মত বন্ধ হওয়ার দিনটাও ছিল একাদশী, আয়াপ্পার রকেট ছাড়ার দিন। সে জানলা দিয়ে দুটো নীল তারার মধ্যে তাকিয়েছিল। অপেক্ষা করছিল কখন একটা রকেট তারাদুটোকে ভেদ করে। প্রাণপণে জগদম্বাকে স্মরণ করছিল। দুটো নীল তারার উত্তর দিকে বাঁকা চাঁদ। অল্প অল্প সাদা মেঘ ভাসছিল। কিন্তু রকেট কই? একটা এরোপ্লেন সেই চাঁদের নীচ দিয়ে যাওয়ার সময় মেঘটায় এসে পড়ল, নীল তারাদুটো ঢাকা পড়ল। পুণ্ডুরী আম্মার চোখের তারাদুটো চিরকালের জন্যে স্থির হয়ে গেল। তার ডানহাতে ধরা পিতলের মেডেলটা, যেটা তার বড় ছেলে মদ খাওয়ার জন্য সোনার মেডেল ভেবে বিক্রি করতে গিয়ে একবার মার খেয়েছিল, আর পুণ্ডুরী আম্মার সারা খাট ছড়ানো চেন্নাই থেকে আনানো নতুন ডিজাইনের বইগুলো, যেগুলো পোকায় কেটে এমন ডিজাইন করেছে যা সেই চিত্রকর নিজে দেখলেও চিনতে পারবে না।
 
 
       গ্রামের লোকেরা ক্রমে ভুলেই যেতে শুরু করল আয়াপ্পাকে। সমুদ্রের জলে এখন দূষণ বাড়ছে। নারকেলের জল এখন আগের মত মিষ্টি হয় না। বালিগুলোর রঙ ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। বাতাসের তাপমাত্রা বাড়ছে। বৃষ্টির দানাগুলো আগের মত শস্যদানার সাথে কথা বলে না। তারা যেন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের বাচ্চাগুলো সবাই জন্মানোর পর থেকেই সাড়ে তিন ইঞ্চির বেশি দেখতে পায় না, সবার চশমা আনাতে হয় তিরুবনন্তপুরম থেকে। গ্রামের যেখানে সেখানে কণ্ডোম, গর্ভনিরোধক বড়ির প্যাকেট পাওয়া যায়; নেশার সিরিঞ্জ, বোতল নারকেল গাছগুলোর গোড়ায়, চাষের ক্ষেতের মাঝে, মন্দিরের আশেপাশে পাওয়া যায়। গ্রামের সবাই অন্যমনস্ক এখন বেশিরভাগ সময়। আয়াপ্পার একাদশীর রকেট এখন আর কেউ দেখে না। গ্রামের মাথায় দুটো নীল তারা কেউ দেখে না। মেঘেদের বাঘ-সিংহ-গণ্ডার হওয়া কোনো বাচ্চা দেখে না। কেউ গল্প বলে না। সারাদিন ডিস্ক অ্যাণ্টেনাগুলো হাঁকরে দূরের গল্প গিলতে থাকে, কাছের গল্পগুলো নারকেল গাছের পাতায় পাতায় জ্যোৎস্নার আলোতে একা একা নিজেদের মধ্যে গল্প করে ফিসফিস করে। কেউ শোনে না এত জোরে জোরে টিভির আওয়াজ হয় বলে। 
       কেউ খেয়াল করল না আয়াপ্পার রকেট দুটো একাদশী উড়ল না। কেউ খেয়াল করল না তার উঠোনে কোনো গরু-মুরগী-ছাগল চরছে না। সারা উঠোন নারকেল গাছের শুকনো পাতায় ভরা। তবে ক'দিন বাদে যখন একটা বাজে গন্ধ বেরোতে শুরু করল লোকে ভাবল সমুদ্রের মাছেরা বুঝি আবার তেল খেয়ে মরেছে। তারা সবাই যে যার বাড়ি থেকে ঝুড়ি বার করে নিয়ে গেল, মরা মাছ আনবে বলে। কিন্তু সবাই সমুদ্রের তীরে এসে দেখল কই মাছ? কিচ্ছু নেই তো? তাদের নৌকাগুলোতে ঝুলের গায়ে সমুদ্রের নোনতা জলের আলপনা। নৌকার কোলের মধ্যে ধুলোর গর্তে কাঁকড়ারা কড়কড় করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তারপর সবাই গন্ধটার উৎস খুঁজতে খুঁজতে আয়াপ্পার বাড়ির দিকে গেল। শুকনো ডালপালা মাড়িয়ে ঘরে ঢুকল। শোয়ার ঘর, বসার ঘর, রান্নাঘর সব ঝুলে ভর্তি। মাকড়সা, চামচিকেরা তাদের অভদ্রের মত অভ্যর্থনা জানালো। কিন্তু কোত্থাও আয়াপ্পা নেই। তারপর গ্রামের সবাই কারখানাটা খুলে ঢুকল। দেখল আয়াপ্পা শুয়ে চিৎ হয়ে। তার বিরাট কালো শরীরে একটা আঁচড়ের দাগও নেই। গরুগুলো, ছাগলগুলো তার গা চেটে চেটে পরিষ্কার করে দিচ্ছে। মুরগীগুলো তার মাথার উকুন বেছে দিচ্ছে। সারা ঘর রকেটের খোল, মালমশলা ভর্তি। তার হাতদুটো দু'পাশে ছড়ানো, হাতের মুঠোয় দুটো রকেট ধরা। তার যে বুকটা প্রতিবার রকেট ওঠার আগে রুদ্ধশ্বাসে আটকে থাকত পাথরের মত শক্ত হয়ে, সে বুকটা স্থির হয়ে গেছে। তার চোখদুটো খোলা, মুখটা হাঁ করা। চোখদুটো স্থির হয়ে ছাদের গর্তে আটকে। সেই গর্তে ঝুল হয়ে সমুদ্রের নোনতা জলের বিন্দুতে আলপনা তৈরি হয়েছে, তাতে সূর্যের আলো এসে পড়ে রামধনু ঝলমল করছে। গ্রামের সবাই যখন সৎকারের আয়োজন করে তাকে আবার নিতে এল, তাদের মনে পড়ল আজ একাদশী। আয়াপ্পার চোখের তারাদুটো তার ছাদের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে দেখা দুটো নীল তারার মধ্যে স্থির। নোনা বাতাস তার মুখের মধ্যে এসে ফিরে যাচ্ছে। ফুসফুসের কাছে অবাঞ্ছিত তারা আজ।