Skip to main content

ভালোবাসার মানুষটাকে ভুলতে পটলা কি না করল। আরো ভালো করে বললে, ব্যর্থ, একতরফা প্রেমকে ভুলতে পটলা কি না করল। তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ালো। পানশালা পানশালায় ঘুরে বেড়ালো। রেসের মাঠে গেলো। জুয়া খেলল। অবশেষে বৈষ্ণব, শাক্ত সব মতে দীক্ষাও নিয়ে ফেললে। কিন্তু পটলার প্রেম এক বিন্দু কমল না। উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। অনিকিনিকে রাস্তায় দেখে। বুকটা ডাঙায় ওঠা মাছের মত ছটফট করে। অনিকিনি দুই ছেলেকে নিয়ে স্কুলবাসে তুলে দিতে যায়, বাজারে যায়, বরের বাইক চেপে বেড়াতে যায়। পটলা সব দেখে। দেখবে না? একই পাড়ায় মুদির দোকান তো। পটলার বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে তার মত ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু হৃদয়ে বসন্ত আক্রান্ত হল ক্লাস নাইনেই। সারা হৃদয় যখন বসন্তের রক্তিম গুটিকায় আর জ্বরে আক্রান্ত তখন দেবী সরস্বতীর মাথায় বাস করা সুকঠিন। তিনিও তাই মদনের হাতে পটলার জীবনের ভার দিয়ে পাশের বাড়ির সুকান্তর মস্তিস্কস্থ হলেন। সে এখন আমেরিকায় গবেষণারত। আর পটলার জীবন নিয়ে কি বলি? শ্রীযুক্ত মদনদেব যার জীবনের ভার নিয়েছে তার জীবনের গতি কবে আর সরল সহজ হল। সে দেবদাসই বলো আর লায়লা মজনু।

যা হোক। ইষ্টদেবী, ইষ্টদেব পটলা সবাইকে ভুলল। পটলাকে ভুলল না মদনদেব। আর পটলা ভুলল না অনিকিনিকে।

পটলা দিনে এক, রাতে এক। পটলার স্মার্টফোনে দিনে থাকে গণেশ কিম্বা রামকৃষ্ণদেব বা সাঁইবাবার ছবি। দিনে রিংটোন থাকে 'ওম জয়জগদীশ হরে' বা, 'ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়' টাইপের গান। রাতে মোবাইলের ওয়ালপেপারে চলে আসে অনিকিনির ছবি। রিংটোন বাজে, "ময়দা চার কিলো, তেল সাদা আর সরষে মিলিয়ে চারটে, সিন্থল বারটা দুটো…. বুঝেছ পটলাদা"....। অনিকিনির গলা। মাসকাবারি বাজার করতে মাসের তিন চার তারিখ আসে। পটলা রেকর্ডারটা অন রাখে। পটলার ফোনে রাতে কেউ ফোন করলেই এই রিংটোন বাজে। পটলা গোটা রেকর্ডিংটা শুনে শুনে মুখস্থ করে ফেলে পাঁচ ছয় তারিখের মধ্যেই। অনিকিনি হাসে, পটলা কাঁদে। অনিকিনির ফর্সা হাতদুটো কল্পনায় ধরে বলে, আমি যে আর পারছি না অনিতুমি কবে আসবে আমার জীবনে….। অনিকিনি জীবনে আসে না, দোকানে আসে।

অনিকিনি কি এসব বোঝে না? অনিকিনি বোঝে সব। মাঝে মাঝে মায়াও লাগে। সত্যিই যদি ভালোবাসতে পারতাম, ভাবেও। কিন্তু ভাবাটা আসে, ভালোবাসাটা না।

পটলা হয় তো ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। নইলে এমন কাণ্ড করবে কেন? পটলা কি করে এত বছর পর এরকম একটা সিদ্ধান্তে এলো, সে বিশ্লেষণ মনোবিদেরা করতে পারবেন, আমি না। আমি বলি পটলা কি করল।

অনিকিনি মঙ্গলবার করে যোগব্যায়াম শিখতে যায়। ফেরার পথে পটলা তাকে ধরল। বলল, অনি তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

অনিকিনি থেকে থেকে বিস্মিত হওয়ার বয়েসটা পেরিয়েছে। সে স্কুটি থেকে নেমে দাঁড়ালো। স্কুটিটা গাছের তলায় স্ট্যাণ্ড করে বলল, কি হল পটলাদা?

পটলা বিনা ভূমিকায়, ছলো ছলো চোখে বলল, আমি আর বাঁচব না অনি। তুমি সব জানো। নতুন করে কি আর বলব। আমি মরব। তুমি পথ করে দাও।

অনি ভুরু কুঁচকে বলল, পথ করে দেব মানে কি পটালাদা?

পটলা একটা শিশি অনির ডান হাতটা টেনে, হাতে দিয়ে বলল, যা পারো তাই রেঁধে এনো। শুধু এই শিশিটা উপুড় করে দিও তাতে। হৃদয় উপুড় করা প্রেম যখন নাই পেলাম, তখন অনি তোমার হাতে বিষের শিশি উপুড় হোক। আমি তোমার প্রেমে বাঁচার স্বাদ না-ই পাই, তোমার হাতের মরার স্বাদ থেকে আমায় বঞ্চিত কোরো না দোহাই তোমায়।

পটলা হাতজোড় করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।

অনিকিনি কিছু বলল না। শিশিটা ব্যাগে ভরে স্কুটি স্টার্ট করে চলে গেল।

পটলা হতভম্ব হয়ে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রইল। গাছের উপর থেকে কাক ডাকল, কা কা কা। যেন কি হল? কি হল? কি হল?

অনিকিনি দুদিন পরে এলো দোকানে। দুপুরে। ফাঁকা দোকান। কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা সবুজ কৌটো বার করে বলল, চিলি চিকেন আছে।

আর দাঁড়ালো না অনি। পটলার দু চোখ জলে ভরে এলো। পা'দুটো অল্প একটু কেঁপে স্থির হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে বাড়ি এলো পটলা।

স্নান করল। সিংহাসনের সামনে বসল। সব দীক্ষামন্ত্রগুলো একে একে মনে করে জপ করল। তারপর মেঝেতে ভাতের থালা সাজিয়ে বসল। পাশে রাখা অনির হাতে তৈরি চিলিচিকেন। আহা কি সুবাস। কে বলবে এতে মেশানো আছে তার প্রাণহরণের যাদুকাঠি!

মোবাইলে অনির ছবিটা সেট করে সবটা চিলি চিকেন দিয়ে ভাত মেখে খেয়ে নিল। উফ, এত ঝাল কেউ দেয়? যে মানুষটা তার শেষ খাওয়া খাচ্ছে তার প্রতি একটু করুণা রাখা যায় না? অবশ্য কার কাছে আর করুণার আশা রাখছে! যদি করুণার লেশমাত্র থাকত, তবে কি আর তার আজ এই দশা হত? হামে উনসে হ্যায় ওয়াফা কি উম্মিদ, জো নেহি জানতে হ্যায় ওয়াফা কেয়া হ্যায়….

খেতে খেতেই গলার কাছটা ধরে আসতে শুরু করল। শ্বাসকষ্ট শুরু হচ্ছে। বুকের কাছটা চাপ চাপ লাগছে। এই তো এসে গেছে সে। পটলা তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। অনি, এসো এসো.. আমার প্রাণে এসো। যে প্রাণ মিলিয়ে যাচ্ছে মহাকালে। আমি বাতাস হব অনি তোমার অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়াব। আমি তোমার স্নানের জল হব অনি, তোমায় ঘিরে ঘিরে নামব। তোমার তৃষ্ণা নিবারণ করব। আমি তোমার অনি শুধু তোমার….

সব অন্ধকার। এ স্বর্গ না নরক? গন্ধটা চেনা তো? জানলার পর্দা উড়ল। ওমা সে তো এখনও জ্যান্ত। ঘুমিয়ে পড়েছিল। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হল কখন সে জানতেও পারেনি। মোবাইল পাশে রাখা। হঠা রিং হল, "গতবারের চা পাতাটা কি ভালো ছিল গো পটলাদা…" অনির গলার রিংটোন। অনিই কল করছে।

হ্যালো

এই নিয়ে বারো-চোদ্দোবার রিং করলাম ভাবলাম বুঝি হার্ট অ্যাটাকেই মরলে ভয়ে ওতে কিছু ছিল না বোকা আর এত তাড়াতাড়ি মরে পরের বারের চান্সটা হাতছাড়া করবে কেন? অপঘাতে মরলে ভূত হয়ে ঘুরবে, আমি আবার কোথায় জন্মাব হয় তো সেবারে আমার মন তোমাতে এলো…. তুমি তো সুযোগটাই দিলে না নিজেকে…. ওঠো, দোকান খোলো সুজি শেষ বড়টাকে পাঠাচ্ছি…. দিয়ে দিও….

পটলা বিষণ্ণ মুখে উঠল, চোখেমুখে জল দিল, দোকান খুলল। প্রফুল্লিত হয়ে দেখল, অনি নিজে এসেছে। পটলা কিছু বলতে যাচ্ছিল, অনি থামিয়ে বলল, এই বাটিটা আনোনি? ওটা হারিয়ো না কিন্তু, তবে তোমার কিন্তু পরের জন্মের চান্সও নেই ওটা নিউ মার্কেট থেকে কিনেছিলাম

পটলার প্রাণে এই প্রথম কিঞ্চি বৈরাগ্যের সূচনা হল। সে বলল, কাল নিয়ে আসব। কাউকে পাঠিয়ে দিলেই হবে।

অনিকিনি চলে যাচ্ছিল, হঠা পটলার মোবাইলে রিং টোন বেজে উঠল "গতবারের চা পাতাটা…", অনিকিনির গলা। ওয়ালপেপারে অনিকিনির ছবি।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল অনিকিনি। চোখের কোলে জল, বলল, তুমি পারোও পটলাদা..

অনিকিনি চলে গেল। পটলার বুকে চিনচিনে ব্যথা। মরার ব্যথা না। বাঁচার ব্যথা। কিন্তু ভুল বুঝেছিল পটলা। চিরকালের মত তার বসন্তাক্রান্ত হৃদয় স্তব্ধ হল গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়, বিনা আড়ম্বরে। এক মুঠো সুখ নিয়ে।