Skip to main content

কান ঘেঁষে গুলিটা চলে গেল। মানুষ মারার গুলি না, বেলুন ফাটানোর।

ভ্রুক্ষেপ করল না। সবাই তার দিকে কেন হাঁ করে তাকিয়ে আছে বোঝার চেষ্টা করল। বেলুনওয়ালার গালাগাল শুনে বুঝল, গুলি কান ঘেঁষে বেরিয়েছে।

ক্লাসে এসে বসল। প্রথমেই বাংলা ক্লাস। মন বসল না। তারপর অঙ্ক, ইংরাজি, ইতিহাস। মন বসল না। টিফিন হল। ক্লাসের বাইরে বেরোলো না। তারপর আবার ক্লাস। ভূগোল, জীবনবিজ্ঞান, লাইব্রেরি। একটাতেও মন বসল না।

স্কুল ছুটি হল। বাইরে বেরিয়ে বেলুনওয়ালাকে খুঁজল। সে বেলুন গোটাচ্ছে। কাছে গিয়ে বলল, আচ্ছা গুলিটা যদি লাগত কি হত, আমি মরে যেতাম?

বেলুনওয়ালা প্রথমে চিনতে পারেনি। একটুক্ষণ তাকিয়ে চিনতে পেরেই বলল, না মরতিস না, তবে কানের ভিতর ঢুকলে, কি গালে লাগলে রক্তারক্তি তো হত! আমায় স্কুলের সামনে আর বসতে দিত?

আবার হাঁটতে শুরু করল। মরত না। বেলুনের মত ধুম করে ফেটে যেত না। কিন্তু গুলিটা শরীরের মধ্যে ঢুকে যেত।

সন্ধ্যে হল। টিউবের আলোয় ঘরটা সাদা। পাশের ঘরে বাবা মা টিভি দেখছে। সে বই বন্ধ করে পাশের ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মা বলল, কিরে খিদে পেয়ে গেল নাকি, এই তো মুড়ি খেলি...যা বোস, চা দিচ্ছি।

সে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, হঠাৎ যদি আমি মরে যাই, তবে কি হবে?

বাবা খবরের কাগজটায় চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, সে তো খুব ঝক্কি হবে। কিন্তু কেন বল তো?

মা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে, টিভির শব্দটা কমিয়ে বলল, কি হয়েছে? আয় এদিকে।

সে গেল। বেলুনের গুলি লাগার গল্পটা বলল।

মা বলল, হুম, ওতে মরে না কেউ, কিন্তু সাবধানী হওয়া উচিৎ ছিল। এত অন্যমনস্ক হলে অন্য বিপদও তো হতে পারত। তোদের স্কুলের সামনে দিয়ে অত জোরে বাস যায়।

সে আবার এসে পড়ার ঘরে বসল। রাস্তার আলোর দিকে তাকিয়ে মনে হল, আজ যদি সে না ফিরত। যদি মরে যেত! কি হত? এই আলোগুলো এমনই জ্বলত, রাস্তা দিয়ে এরকমই সাইকেল রিকশা যেত তো।

সে একা শোয়। ঘুম আসছে না। অনেক রাতে ছাদে উঠল। সারা আকাশ জুড়ে কত তারা। ধুম করে মরে যাওয়াটা ভালো না। সে বোকামিই করেছে। আরো সজাগ থাকা উচিৎ ছিল।

দুদিন পর, অনেক রাত, সে অঙ্ক করছে, হঠাৎ বাইরের দরজায় কেউ এলো, পায়ের আওয়াজ পেলো। কলিংবেল বাজল। পাশের বাড়ির দিদি। তার ঠাকুমার শরীর খুব খারাপ। বাবার স্কুটারে করে ডাক্তার আনতে হবে।

ডাক্তার এলো। ততক্ষণে উনি মারা গেছেন। অনেকদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। বাবা শ্মশানে গেল। সেও গেল জেদ ধরে। চুপ করে একটা কোণে দাঁড়ালো। কত মানুষ মারা যায় সারাদিন।

এরপর দিন কেটে গেল। সে নতুন ক্লাসে উঠল। বেলুনওয়ালাকে দুদিন দেখল না। কদিন পর শুনল সে নাকি মারা গেছে। হঠাৎ বুকে ব্যথা হল সকালে, তারপর মারা গেল কাউকে ডাক্তার ডাকার সময় না দিয়েই। তার মন খারাপ হল। একা একা শ্মশানে গেল একদিন। মনটা ভার হয়ে থাকল।

দিন পনেরো পর তার থেকে একটু বড় একটা ছেলে এলো বেলুন আর বন্দুক নিয়ে স্কুলের সামনে। তার মাথা কামানো।

সে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাম কি?

ছেলেটা বলল, রাকেশ। তোমার?

সে বলল, ভাস্কর।

একটু হাসার চেষ্টা করল। হল না। ধীরে ধীরে ক্লাসের দিকে যেতে যেতে আবার ফিরে এলো, তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল, তোমার বাবার নাম কি ছিল?

ছেলেটার চোখ চিকচিক করে উঠল। সে বলল, লছমন।

তার গলাটা ধরে এলো।

ক্লাসে যেতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে রাকেশের সঙ্গে গিয়ে বসে।

গেল না। ক্লাসে এসে বসল। বুকের কাছে ধরে থাকল এক খামচা কষ্ট।