টয়লেট থেকে টুলটুলের, ওমা!! মরে গেলাম গো… চীৎকার শুনেই বনিতা বুঝল, এই দুপুর আড়াইটের জেট স্প্রে… ছাদের বিয়াল্লিশ ডিগ্রির ট্যাঙ্কের জল।
টুলটুল বেরিয়ে এলো। সারা গা ঘামে সপসপ করছে। ফর্সা মুখটা লাল।
বনিতা বলল, বলেছিলাম রান্নাঘর থেকে দু'মগ জল নিয়ে যা। ধরা আছে। মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে কানে কোনো কথাই ঢোকে না…. রেজাল্টটা বেরোক…. কোন কলেজে যে চান্স পাবি….
টুলটুল শরীরটা থেবড়ে চেয়ারে বসে চোখটা বন্ধ করে দিল। এরপরের কথাগুলো সব চেনা। ব্যায়াম বন্ধ করে রাতদিন গিলছিস, গড়াচ্ছিস, মোবাইল ঘাঁটছিস, আর একটা কুমড়ো হচ্ছিস….
টুলটুল বলল, মা, পাখাটা কি ফুলস্পিডে?
বনিতা ভাত বাড়তে বাড়তে বলল, না রে একে দিয়ে রেখেছি…. শীতে মরে যাচ্ছি কিনা….
টুলটুল আর কথা বাড়ালো না। খেতে খেতে বলল, টকদই খাব না…
বনিতা বলল, তোর ঘাড় খাবে….
টুলটুল চুপ করে মাথা নীচু করে খেয়ে শোবার ঘরে গিয়ে এসিটা অন্ করল। নেটফ্লিক্স চালালো। কি দেখবে?
=====
আবার ওসব আছিস্টি কুছিস্টি চালিয়েছিস? কেন রে…. এই শোন…. তোর আজকাল আর আঁকতে ইচ্ছা করে না, না?
টুলটুল ল্যাপটপটা সরিয়ে বনিতাকে জড়িয়ে শুলো। বনিতা বলল, ন্যাকামি না করে মায়ের কথাগুলো শুনতে পারিস তো….
টুলটুল বলল, স্বয়ং বিদ্যাসাগরই শুনিত না হে জননী…..
বনিতা বলল, আর উনি বাকি যে কাজগুলো করতেন… মানে পড়াশোনা….
টুলটুল বলল, আচ্ছা তোমার মাথায় কি শান্তি বলে কিচ্ছু নেই…. এই যে বাবাকে এত জ্ঞান দাও মনটা ঠাণ্ডা রাখো…. কেন? নিজে তো মিক্সির মত পাঁইপাঁই করে ঘুরেই যাচ্ছে…..
বনিতা বলল, আচ্ছা তোর কি সত্যিই পড়াশোনা করতে ইচ্ছা করে না?
টুলটুল বলল, করে। আবার করেও না।
বনিতা অন্যমনস্ক হল। টুলটুল মোবাইল অন্ করে ইনস্টাগ্রামে ঢুকল। বনিতার কোলের কাছে টুলটুলের মাথা। বনিতা হঠাৎ বলল, আচ্ছা বাবু, যদি বাবা আর না ফেরে?
টুলটুল মোবাইলের থেকে চোখ উঠিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে বলল, মানে?
=====
বিপুল হাঁপিয়ে উঠছিল। সাফোকেশান শব্দটা বড্ড ক্লিশে। মনোটোনাসটাও। বিপুল একা থাকতে চায়। নিজের সঙ্গে। কাজের জায়গা কলকাতা থেকে বাইরে করে নিয়েছে। বাইরে মানে দেশের বাইরে। আইনি বিচ্ছেদ এখনই চাইছে না। কিন্তু দূরত্ব চাইছে। যদিও ডাক্তার বলছে একা থাকা তার পক্ষে ঠিক না। তবু। দেরি আছে। এখনই নয়।
টুলটুল নিজের রুমে চলে এসে দরজা বন্ধ করল। খবরটা নতুন না। আগেও হয়েছে। বাবা বাইপোলার। মাও যেন থেকে থেকে হয়ে যাচ্ছে। অসহ্য লাগে। মোবাইল অন্ করল। বন্ধুদের কাছে সে সানি। সানি বিশ্বাস। সব ডিপি কালো করে দিল। ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক। টিন্ডার অন্ করল। ইনস্টা চ্যাট অন্ করল। ব্যাডলি নিড অ্যা ব্লো জব। জাস্ট দ্যাট মাচ। টু ফিক্সড দ্য মুড। সামনের মাসেই আঠারো হয়ে যাচ্ছে। যদিও সে জানে এজ ইজ জাস্ট এ নাম্বার। ফিলটাই আসল। মুড ইজ কিং। টাইম ফিক্সড। রনোর বাড়িতে মঞ্জুলা আসবে। কলেজে পড়ে। ওর টাকার দরকার। এগুলো করে দেয়। চাপ নেয় না। নামটা ভালো সময়ে ক্লিক করল মাথায়। নইলে এক্কেবারে ব্লাইন্ড, আন্নোন হলে রিস্ক থাকে। ব্ল্যাকমেল। আরো নানা ফ্যাচাং।
=====
সানি রেডি হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মাকে কিস করল। মা এখন কাঁদবে। নইলে কিছু বোরিং ননসেন্স বাংলা কবিতা পড়বে। কবি দেখলেই সানির মনে হয় সব শালা পার্ভার্ট। মায়ের অনেক কবি বন্ধু আছে। মাঝে মাঝেই এখানে সেখানে বই ওপেনিং-এ যায়। কয়েকবার সানিও গেছে। অবশ্যই ছোটো থাকতে। তবু বুঝেছে কারা মায়ের বুকের দিকে তাকায় কথা বলতে বলতে, মায়ের কোমরের দিকে, নাভির দিকে, ঠোঁটের দিকে তাকায়। এক কৌস্তভ আংকেল ছাড়া। কিন্তু যা সন্দেহ করেছিল তাই, মাল গে ছিল। বাংলা কবিতা মানে জাস্ট কিছু ফ্রাস্ট্রেটেড মালের ভার্বাল মাস্টারবেশন। হাত মারা। শালা।
=====
বনিতা ছাদে উঠল। বিকেল। এখনো কি তাপ! ছাদে কেউ ওঠেনা জেনেরালি। বনিতা ওঠে। একা লাগলে ওঠে। ছাদ থেকে কলকাতাকে দেখতে ভালো লাগে। আজ কাবেরীর কবিতার বই বেরোবে। কলেজ স্ট্রিটে কি একটা ক্যাফেতে। হোয়াটস অ্যাপ করেছে। গেলেই হয়। হয় তো ভালো লাগবে। নাকি অভ্যাসের উপর দাগ বুলিয়ে মানুষ স্বস্তি পায়, নিজেকে সিকিওর লাগে বলে? সত্যজিতের কাঞ্চনজঙ্ঘায় আছে না? ভালোবাসার চাইতে সিকিউরিটিটাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ লাগার কথা। এটাই ম্যাচিউরিটি। একটা বয়সের পর সব কিছুকে সিকিওর করতে চায় মানুষ। ওতেই সাকসেস। ওতেই সুখ। তাই কি?
মায়ের মুখটা মনে পড়ল। নিন্মবিত্ত ছিল তারা। কাঁকিনাড়ায় থাকত। বাবা জুটমিলে কাজ করত। মা সন্ধ্যেবেলা রোজ তাকে আর ভাইকে নিয়ে "গুরুদেব দয়া করো দীনজনে" গাইত। মাঝে মাঝে বাবাও বসত। তখন তো এত সিকিউরিটি ছিল না। এত প্রাচুর্য ছিল না। কিছু একটা তো ছিল? সেকি দারিদ্র্য নিয়ে আননেসেসারি রোম্যান্টিসিজম করছে? জুঁই বলে। জুঁই ব্যাঙ্কে কাজ করে। প্রচুর মাইনে। ও বলে, তোদের এই বাঙালিদের মধ্যে দারিদ্র্য নিয়ে একটা টাটকা রোমান্টিসজম আছে। কি পলিটিক্সে, কি লাইফস্টাইলে… তোরা ল্যাভিশ থাকাটাকে পাপ মনে করিস। একটা কালেক্টিভ গিল্টি ফিলিংসে ভুগিস। ওই জন্যে তোদের কিস্যু হয় না।
=====
বনিতা তৈরি হয়ে গাড়িতে উঠল। জুঁই বুঝবে না। বাঙালি হলেও ওর বাবা কেরলিয়ান। মুম্বাইতে মানুষ। মা বাঙালি। তাও আন্টি দিল্লীর মেয়ে।
সবটাই অভ্যাস। এই যে টুলটুলকে নিয়ে অবসেসান। ওর পরিবর্তনটাকে ইগনোর করে, ওর সিউডো ইনোসেন্সকে ইনডালজ করে কি পাচ্ছে? ওর ব্যাগে কন্ডোম দেখেছে ক্লাস টেনে। কিচ্ছু বলেনি। মানসিক রোগকে ভীষণ ভয় করে এখন। হেল্পলেস লাগে। বিপুল ভালো মানুষ। ভীষণ ভালো, কেয়ারিং। কিন্তু… সব সময় সেকি বিপুল? সানি, টুলটুল…. বিহঙ্গ… সবাই কি এক? বিহঙ্গ নামটা মা দিয়েছিলেন। টুলটুলের পছন্দ নয়। ও সানি বলে নিজেকে পরিচয় দেয়। কেউ রাখেনি নামটা। ও নিজেই রেখেছিল।
=====
রাতে খাওয়ার পর বিপুল শুতে চলে গেল। টুলটুল খেল না। মাথা ধরেছে বলে রুম থেকেই বেরোল না। মদের গন্ধ পেয়েছে বনিতা। বিপুল পেলেও বলবে না। ও নিজের মত বাস্তব বানিয়ে বাঁচে।
বনিতা আবার ছাদে উঠল। রাত এগারোটা পঞ্চাশ। মা আকাশের তারা। বাবাও। ভাই ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে….. তারা কি? নাকি ধূমকেতু?
ভীষণ সিকিওর লাইফ। তবু কি যেন নেই? ভাষায় কি সব বলা যায়? বুকটা ফাটা রাস্তার মত হাঁ হয়ে আছে। এগোনো যায় না। কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া যায়। ইচ্ছাকে। ইচ্ছাগুলোকে। স্বাধীন, শর্তহীন ইচ্ছা বলে কি আছে তার? ইচ্ছা এত প্রেডিক্টেবল আজকাল সবার! মানুষের ইচ্ছাগুলো প্রেডিক্টেবল হতে শুরু করলে সে ফুরিয়ে গেছে, ধরে নেওয়াই যায়।
বনিতা বসল। গুরুদেব দয়া করো দীনজনে…. গাইছে। সুর আসছে। বিশ্বাস জন্মাচ্ছে না। নতুন বিশ্বাস নেই বলেই নতুন ইচ্ছা জন্মায় না আর। মানুষ কি বিশ্বাস করবে? কাকে?
বনিতা ছাদের ধারে এসে দাঁড়ালো। খুব হাওয়া দিচ্ছে। নীচে কেউ কেউ একা হাঁটছে। ঝাঁপ দিলেই সব শেষ। কাল ভোরের চা থেকে শুরু করে… সব শেষ।
বনিতা দাঁড়িয়ে আছে। মৃত্যুর ওপারটা নিশ্চয়ই এখনও পুরোনো হয়ে যায়নি। সেখানে নিশ্চয়ই কিছু আছে। হয় তো সীমাহীন নিরুদ্বেগ শূন্যতা। তবু কিছু থাক। কিছুর জন্য সে বাঁচুক। এত তাড়াতাড়ি কেন? এইটুকুই তো আশা, একদিন সব শেষ হয়ে যাবে। সব সব সব।
বনিতা নামছে সিঁড়ি দিয়ে। অভ্যাসের কাছে। মিথ্যার কাছে। যে মিথ্যার নাম দিয়েছে সে সংসার। হোক, তবু এ মিথ্যা তার একার মিথ্যা। এও বা কম কি! সান্ত্বনা? হবে হয় তো। ভাষার কাজই তো সান্ত্বনা খোঁজা। একা একা পুড়তে পুড়তে।