দক্ষিণেশ্বরের নাটমন্দির। সন্ধ্যেবেলা। কালীকীর্ত্তন চলছে। গোল হয়ে বসে ভক্তবৃন্দ। কারোর চোখ বন্ধ, কারোর আধবোজা, কারোর খোলা। সংসারের বাইরে মনটাকে এনে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা যেন কোথায়। কত ক্ষোভ, কত জ্বালা, কত অসহায়তা, কত অভিমান - সব ভোলো। গাও মন গাও।
দলের মাঝখানে একটা মেয়ে। যেন কৈশোর আটকে আছে যৌবনের দরজায়। মাথায় জটা। নোংরা সালোয়ার কামিজ গায়ে। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে হাসি। সংসারের না। তৃপ্তির না। পাগলামীর হাসি। সে নেচে এগিয়ে আসছে, আবার পিছোচ্ছে। তাতে না আছে ছন্দ, না তাল। তবু ও যেন কিছু ভুলতে চাইছে। কি ভুলতে চাইছে? খিদে? না শরীরের আরো গভীর কোনো অপমান? আচ্ছা মান-অপমান বোধটা কি সমাজ গড়ে দেয়? না সেটা সহজাত? সমাজ দেয়। সমাজ দেয় বলেই কি এত সহজে নেয়?
নাটমন্দির থেকে চাতালে নামলাম। সার দিয়ে ভক্তরা। পূজোর ডালি নিয়ে। কত কি চাইবে। এত কি চাওয়ার থাকে? মাথার উপর সেই আদিম চাঁদ, পুরোনো আকাশটার সামিয়ানা টাঙিয়ে। কত যুগ যুগ ধরে কত লক্ষ লক্ষ চাওয়ার সাক্ষী সে। কটা চাওয়া পূরণ হতে দেখেছে সে?
বাঁ'হাতে সার দিয়ে শিবমন্দির। ঘন্টা বাজছে। আরতি চলছে। সিঁড়িতে বসে অনেক নতুন প্রজন্ম। ব্যস্ত স্মার্টফোন। গা ঘেঁষে বসা ভালবাসা।
আলোকিত মাতৃমন্দিরের চূড়া পিছনে রেখে ঢুকলাম ঠাকুরের ঘরে। চোখ বন্ধ শ্রদ্ধাবদ্ধ কিছু মানুষ। মুখমন্ডল গম্ভীর। যেন খুব গভীরে যাওয়ার চেষ্টা। তবু কোথায় যেন আটকাচ্ছে। সংসার? জানি না। উদাস চোখে তাকিয়ে কেউ কেউ। যেন বুঝেছে - জীবনে সব প্রশ্নের উত্তর না পেলেও জীবন চলতেই থাকে চলতেই থাকে। তাকে অস্বীকার করা যায় না।
উঠে আসলাম। ঠাকুরের আরাত্রিক গাইছেন একদল ভক্ত বাইরে বসে। বেশ সুর। তবে খুব কঠিন। স্বামীজির সাথে দেখা হলে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, এত কঠিন সুর করলেন কেন?
গঙ্গার ধারা। তার উপরে সন্ধ্যের কলকাতার আলোর গঙ্গা। জীবনের আলো। উৎসবের আলো।
সারদাদেবীর ঘর। গিয়ে বসলাম। একজন মাঝবয়সী মহিলা। চশমা দুটোর ফাঁকে বড় উদাস দুটো চোখ। কতটা আঘাতে মানুষের চোখদুটো এতটা উদাসীন হয়? কিছুক্ষণের জন্য মনটা আটকে গেল। ফিরে তাকালাম ক'বার। সংসারের উপর যেন গভীর অভিমান। কেন? গালের উপর ক্ষীণ জলের দাগ মোছেনি এখনো।
আমি চোখ বন্ধ করলাম। আমার আশেপাশে হাজার নরনারী। কত চাওয়া, কত অনুভূতি, কত আশা-নিরাশা, অভিমান সংশয় দ্বন্দ্ব। সামনের মা সারদার ছবি। খুব অবাক বিস্মিত করে এই চরিত্রটা আমায়। এত ধৈর্য্য, এত সহনশীলতা, এত উদারতা... কঠোর বাস্তবতার সাথে এক স্বর্গীয় ভালোবাসা মেলালেন কি করে?
সব ভেঙে গেলেও যেন কি বিশাল এক আশ্বাসে উনি সব বেঁধে দিতে পারেন। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ অলৌকিক শক্তিতে - মাতৃস্নেহের শক্তিতে।
মন্দিরের বাইরে এলাম। পরিপাটি করে সাজানো দোকান। নানান পসরা। এখানে ভাবের রাজ্য না। দর কষাকষি, ছবি থেকে ডালি নিয়ে। কচুরী মিষ্টির দোকানে উৎকৃষ্ট খাবারের উচ্চৈস্বরে আমন্ত্রণ। সেই খিদে। আরেকটু এগোলেই যে দু'হাত পেতে সার দিয়ে বসে। দু'টো পয়সার জন্য। এবার তুমিই দেবতা। ওরা হাত পেতেছে তোমার কাছে। তোমার ভাবের কাছে। তোমার করূণার কাছে। ওরা কাড়বে না। চাইবে। না দিলে শাপ দেবে না। অভিমান করবে না। শুধু ক্ষুধার্ত পেটে আরেকজনের মুখের অপেক্ষায় চেয়ে থাকবে। অসহায় তুমিও, সেও। অন্যভাবে।
অটোতে উঠতে যাব, দেখলাম সেই ভদ্রমহিলা। বাস স্ট্যান্ডে। চোখদুটো তাকিয়ে আছে, কিছু দেখছে না। কাঁটার মত বিঁধে থাকল সেই দৃষ্টিটা, কি নিল সংসার ওর কাছ থেকে? সে কি ফেরৎ চাইতে আসে না ভুলতে আসে? জানি না।