পাহাড়ে ঘেরা এক চিলতে জমি। হয় তো উর্বর। কিন্তু কেউ জানে না। পাহাড়গুলো এত উঁচু যে আজ অবধি কোনো মেঘ এসে এই এক চিলতে অভাগা জমিটার উপর দাঁড়ায়নি। মেঘ পাহাড়ের ওদিকে গিয়ে জমে। বৃষ্টি হয়। ঝর্ণা হয়ে সে জল নামে। কুলকুল শব্দ হয়। এই এক চিলতে জমি, সে সব কান পেতে শোনে। নিজের রুক্ষ শুষ্ক চেহারার দিকে তাকায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার বুকের উপর অনেক কষ্টে জন্মানো কয়েকটা বুনো গাছ সেই দীর্ঘশ্বাসে পুড়ে যায়।
কেউ কেউ বলে, এই জমি নাকি কোনো অভিশপ্ত সাধু। সে নাকি বহু শতাব্দী আগেকার গল্প। এই সাধক অনেকদিন ধরে এইখানে বসে তপস্যা করত। তখন এখানে কোনো পাহাড় ছিল না। একটা বড় সরোবর ছিল। তার জলের রং নাকি ছিল গোলাপি, আর কি মিষ্টি সে জল!
সে সাধক সিদ্ধিলাভ করল। কিন্তু তার এমন অহংকার হল যে সারা জগতকে তুচ্ছ জ্ঞান করল। ঈশ্বরকে ভাবল নিজের ক্রীতদাস। ঈশ্বরের করুণাকে ভাবল দুর্বলতা।
একদিন এক ব্যাঙ দম্পতি এই সরোবরে খেলা করছিল। তখন বর্ষাকাল। কামাতুর সেই ব্যাঙেদের ক্রীড়ার শব্দে সাধকের ধ্যান বারবার ভেঙে যেতে লাগল। সাধক ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে নিজের সিদ্ধিলব্ধ দৃষ্টি দিয়ে তৎক্ষনাৎ স্ত্রী ব্যাঙটাকে দিল ভস্ম করে। পুরুষ ব্যাঙকে বলল, মর এবার তুই একা এই সরোবরের জলে। এতবড় স্পর্ধা তোর, তুই আমার এই পুণ্য সাধনপীঠে আদিরসের ক্রীড়ায় মাতিস! মূঢ়!
সেই পুরুষ ব্যাঙ, প্রবল মর্ম যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে বলল, তোমার সাধনা অসম্পূর্ণ সাধক, তুমি আর যাই পেয়ে থাকো, মর্মের মর্মস্থলেই প্রবেশাধিকার পাওনি। তবে বিশ্বের মর্মস্থলে যার বাস, সেই পরমানন্দকে জানবে কি করে! তোমায় আমি অভিশাপ দিলাম, তুমি এই মুহূর্তে এক রুক্ষ শুষ্ক জমিতে পরিণত হও। তোমার সমস্ত সিদ্ধাই তোমার চারিদিকে পর্বতসম হয়ে মেঘের আসার পথ করুক অবরুদ্ধ।
এই বলে তৎক্ষনাৎ ব্যাঙটি দেহত্যাগ করল। সাধক শুষ্ক রুক্ষ জমিতে পরিণত হল। আর তার সমস্ত সিদ্ধি হল পাহাড়। যুগ যুগ এইভাবে কেটে গেল।
একদিন অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। কি করে যেন এক চিলতে মেঘ ঢুকে পড়ল। সে চারদিকের রুক্ষতা দেখে অবাক হয়ে বলল, এখানে সব এমন রুক্ষ কেন?
কেউ কোনো উত্তর করল না। মেঘ আরো কয়েকবার প্রশ্ন করে যে পথ দিয়ে এসেছিল, আবার সেই পথেই গেল ফিরে। সে একাই আবিষ্কার করেছিল এ গোপন পথ এত যুগ পরে।
রুক্ষ জমি এতদিনে মেঘের দেখা পেয়ে পাগলপ্রায় হয়ে গেল। সে প্রাণপণে পাহাড়গুলোকে বুকের সমস্ত পাঁজর দিয়ে ঠেলে সরাতে চেষ্টা করল, এক তিলও নড়ল না পাহাড়গুলো। সে চীৎকার করতে চেষ্টা করল, কিন্তু এত দিনের শুষ্ক কণ্ঠে শব্দ জাগাবার ক্ষমতা কই? সারারাত ঘুমালো না। সারা সপ্তাহ দু চোখের পাতা এক করতে পারল না। সে যেন বদ্ধ উন্মাদ।
মেঘ এল পরের সপ্তাহে আবার। এসে সে যেন কিছু অনুভব করল। করবে না? বাতাস আরো আরো তপ্ত হয়ে উঠেছে যে, সে জমির তাপে, উন্মাদনার আকুলতায়। মেঘ কান পাতল জমির বুকে। জমি চাইল তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু এমন তার তৃষ্ণা, তার আলিঙ্গন হল শিকলের মত নিষ্ঠুর, কঠিন। মেঘ আতঙ্কিত হয়ে গেল পালিয়ে।
জমি নিজের মাথায় নিজে করাঘাত করল। একি করল সে! এতদিনের তৃষ্ণা তাকে এমন অর্বাচীন করে তুলেছে! এত এত কাঙালপনা তার! এবার সে ঠিক করল, মেঘ এলে সে নিজেকে সংযত রাখবে। কিচ্ছু বলবে না। তার বুক ফেটে চৌচির হয়ে গেলেও না।
মেঘ আবার এলো। জমির প্রাণে জাগল হাজার বছরের তুষানল। সে তুষে পুড়তে পুড়তে সে মেঘের দিকে করুণ চোখে চাইল। এই প্রথম তার চোখে জাগল এমন কোমলতা। তার চোখ পড়ল মেঘের চোখের উপর। সে দৃষ্টির অভিঘাতে মেঘের প্রাণ হল চঞ্চল। সে বলল, আমি আজ আসি। আবার আসব। জমি কোনো অনুরোধ করল না, বলল আচ্ছা।
মেঘ আবার এলো। তখন বসন্ত এসেছে সদ্য প্রকৃতির আঙিনায়। মেঘের চোখে আবার চোখ পড়ল জমির। মেঘ আশ্চর্য হয়ে গেল দেখে জমির চোখের এক কোণায় টলমল করছে এক বিন্দু জল। এত যুগের শুষ্কতাকে মন্থন করে জাগা এ জলের মূল্য কি অপরিসীম! মেঘ তার বুক সিঞ্চন করে জমিকে দিল কয়েক পশলা বৃষ্টি।
মেঘ ফিরে গেল। জমি জানত সে আর ফিরবে না। মেঘ সত্যিই আর ফেরেনি কোনোদিন। জমির বুকে এখন শুধু পাহড়ের ফাটল ধরার শব্দ, যন্ত্রণা। সেকি প্রবল যন্ত্রণা। জমির পাঁজর চিরে ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে আসছে জল। পাহাড়ের ফাটল দিয়ে ঢুকছে সজল হাওয়া। জমি আজ সব সহ্য করে নিচ্ছে। এ ভাঙন ধরার তপস্যাই আজ তার তপস্যা। নিজের সমস্ত কীর্তি, যা শুধু অহমিকাকে ডেকে এনেছিল, তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলার সময় এখন। জমি মেঘের উদ্দেশ্য আনত কৃতজ্ঞতা জানালো। মনে মনে বলল, আমি যোগ্য নই তোমার ভালোবাসার, মেঘ। তবু আমার বুকে ফোটা প্রথম ফুলটি ফুটুক তোমার নামে। সেদিন যদি পারো তবে এসো, আমি অপেক্ষায় থাকব। আমার আলিঙ্গনকে শৃঙ্খল হতে দেব না, কথা দিলাম।