Skip to main content

 

কোনো এক দেশে এক নটী ছিল। তার অভিনয়ে ধার কতটা ছিল বলা শক্ত, কিন্তু জিভে ছিল প্রবল ধার। সে সত্য মিথ্যা, বাস্তব অবাস্তবের পরোয়া কর‍ত না, সে খালি বলত রাজার মঙ্গলেই আমার মঙ্গল। এমন রাজভক্ত নটী দেশে কেন, বিদেশেও দুর্লভ। রাজা তাকে তাই অনেক অনেক পুরষ্কারে ভূষিতও করেছিলেন। সে সব পুরষ্কার নিজের বসার ঘরে সাজিয়ে রাখত। আর কেউ দেখা করতে গেলেই বলত, এ আমার সত্যবচনের পুরষ্কার। স্বীকৃতি। কেউ যদি বলত, সত্য কি? সে বলত, রাজার ভালোতেই আমার ভালো দেখা। এই পরম সত্য। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করত, রাজার ভালো যদি প্রজার ভালোর বিপরীতে যায়? সে বলত এ তত্ত্বই মিথ্যা। রাজার ভালোতেই প্রজার ভালো। নিন্দুকে তাকে বলত অন্ধ। নটী নিন্দুকদের বলত দেশদ্রোহী।

ঝড় উঠলে ধুলো যেমন মন্দিরের মাথায় গিয়ে ওঠে আর আকাশকে ভাবে আরেকটা ঝড়েই ছুঁয়ে ফেলবে, আমাদের গল্পের নটীও সে-ই ভেবেছিল। ক্রমে তার গলার স্বর হতে লাগল তীক্ষ্ণ। তার সত্য মিথ্যার বোধ চাটুকারিতায় এমন গুলিয়ে গেল যে নিজের ভাষার মর্মোদ্ধার করা নিজেরই কঠিন হতে শুরু করল।

একবার দেশে রাজা চাইলো দ্বিগুণ কর প্রজাদের থেকে। প্রজারা বসল হরতালে। রাজা রইলেন নিরুত্তর। কিন্তু নটী বলে চলল একের পর এক বিষাক্ত ভাষ্য। রাজা ইঙ্গিতে বললেন, চুপ করো নটি। নটী ভাবল রাজা বোধহয় হচ্ছেন দুর্বল। সে রাজাকে সবল করতে গিয়ে আরো বিষাক্ত ভাষ্যে দেশ ছেয়ে ফেলল। ক্রমে সে কাঁটাগাছের মত রাস্তার একপাশে দাঁড়ানো সবার উপেক্ষার বস্তু হয়ে গেল। সে বললেও কেউ শুনত না। সবাই জানত সে শুধু নটী। একটি চরিত্রে এমন আটকে গেছে যে মঞ্চ ছেড়ে নামার তো নামই নেই, সহ অভিনেতা কেউ না থাকলেও স্বগতোক্তিতেই সময় অতিবাহিত করতে চাইছে।

একদিন রাজা হঠাৎ করে তুলে নিলেন কর। এইবার নটী কি করে? তার বিষাক্ত ভাষ্যেরা সব অভিমান করে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে বলল, আমরা কি তবে এতই ফেলনা?

নটীর বুকে জমল প্রবল অভিমান। সে খেলো না। কারোর সঙ্গে কথা বলল না। সে শুধু বলল, রাজার এই ব্যবহারে সে ভীষণ লজ্জিত। রাজা কেন হবে এত দুর্বল?

রাজা তাকে উপেক্ষা করল। প্রজারা তাকে উপেক্ষা করল। শুধুমাত্র কয়েকটা লোক, যারা তার বিষাক্ত ভাষ্য ছাপিয়ে দুটো পয়সা রোজগার করে, তারা তাকে উসকিয়ে আরো কিছু নতুন ধরণের বিষ বার করা যায় কিনা চেষ্টায় লেগে গেল।

সে অভিমান করে আরো বলল, আমি কি বলিনি আমাদের রাজার ধর্মে শুধুই গোলাপ, নেই কাঁটা? আমি কি বলিনি আমাদের স্বাধীন দেশ ছিল আসলে পরাধীন রাজা আসার আগে? আমি কি রাজাকে বড় করতে গিয়ে, বিরাগ অঞ্জনের কালিতে বাকিদের চুবাইনি? আমার সত্য মিথ্যাকে কি আমি রাজার তোষণের জন্য জলাঞ্জলি দিইনি? তবে কেন এই বিশ্বাসঘাতকতা?

নটী বলেই চলল, বলেই চলল। কেউ বলল না চুপ করো। সবাই উসকে দিয়ে বলল, বেশ বেশ, আরো বলো নটী আরো বলো।