Skip to main content

শূন্য খাঁচায় পাখি ডাকে না। কিন্তু পাখির ডাকের স্মৃতি?

হরিদেব বসে আছে শূন্য খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে। রাতে রোজ একটা পাখি আসে। হরিদেবকে জানলা দিয়ে ডাকে, ও হরিদেব, হরিদেব… জানলা খোলো… আমায় দেখো… ক্ষেতে যাবে না? বীজ বুনবে না?… মাটিতে দেবে না? হরিদেব… ও হরিদেব.. এই তো আমি…. তোমার খাঁচায়। এসো এসো। বাইরে এসো।

হরিদেবের বুকটা হাঁ হয়ে যায়। সমুদ্রের মত উথালপাতাল শুরু হয়। হরিদেব কানে হাত দেয়। মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে বলে, মা ও আবার এসেছে। ওকে বারণ করো। মা, ওকে চলে যেতে বলো। ও আবার তোমায় কষ্ট দেবে। আবার তোমায় জ্বালাবে। ও মা, মা…. আমি.. এই যে আমি… এই আমি হরিদেব… তোমার নয়নের মণি… তোমার চাঁদ…. তোমার সব কিছু.. মা… ও মা… আবার এসেছে ওই নষ্ট পাখিটা… মা… ওকে তাড়াও…..

মা ছবি থেকে হাই তোলে। তারপর ছবির ফ্রেমের থেকে বাইরে আসে। হরিদেবের মাথায় হাত রাখে। মায়ের মুখের পানের গন্ধে হরিদেব ঈশ্বরের গন্ধ পায়। মায়ের শাড়ির আঁচলের গন্ধে হরিদেব ঈশ্বরের আঁচলের স্পর্শ পায়। মা ডান বাঁ দুই হাতের আঙুলগুলো তার কোঁকড়ানো চুলের মধ্যে দিয়ে দেয়। হরিদেব দেখে ঈশ্বর বিশ্বরূপ ধারণ করে তাদের কলাবাগানের মধ্যে বসে আছে।

মা ধীরে ধীরে, পা টিপে টিপে রান্নাঘরে আসে। তাকে ইশারায় ডাকে। তারপর একটা দা হাতে নিয়ে বাইরে আসে। পাখিটা হরিদেবকে ডাকতে ডাকতে ঘুমিয়ে পড়েছে। হরিদেব পাখিটার যত কাছে যায় তত তার সে উথাল-পাতাল বাড়ে। তার তলপেট জুড়ে ব্যথা শুরু হয়। ক্রমশ তার পুরুষাঙ্গ আর হৃদয় গোঙাতে শুরু করে। যে গোঙানির ডাক শুনে পাখিটার ঘুম ভেঙে যাবে। সে এসে হরিদেবের হাঁ হয়ে যাওয়া বুকটার মধ্যে বসবে। তারপর কি হবে হরিদেব জানে। তার মা ঈশ্বরের মত বধ করবে তার হৃদয়কে, চালকুমড়োর মত বলি দেবে, দু আধখানা করে। মা বলি চায়। হৃৎপিণ্ড চালকুমড়ো তার। পাখিটা মরে পড়ে থাকবে তার বুকে। তার পালকগুলো উড়িয়ে দেবে হাওয়ায়। রক্তগুলো ভাসিয়ে দেবে নদীতে। হাড়গুলো পুঁতে দেবে মাটিতে। পুঁইশাক লাগাবে সেখানে। হাড়গুলো পুঁইশাকের ডালের মত বেঁকে বেঁকে উঠবে। হাত বাড়াবে হরিদেবের দিকে। তার মা আসবে ঈশ্বরের মত। ছিনিয়ে নেবে ডাল। বলবে, হাটে এসো বেচে।

হরিদেব হাটে বেচতে যাবে। মায়ের তৃতীয় নয়ন যাবে তার সঙ্গে। ওজন দেখবে। পয়সা গোনা দেখবে। অপলক। বেচা শেষ হবে। তৃতীয় নয়ন বলবে বাড়ি আয়, বাড়ি আয় খোকা। তোর জন্যে পায়েস আর মুড়ি বানিয়ে রেখেছি। মা মুড়ি ভাজতে বসেছে। পাশের উনুনে ফুটছে পায়েসের দুধ। আকাশ থেকে মধু আনিয়ে মিষ্টি করছে মা। মা পৃথিবীর সব মধুর খোঁজ জানে। পাখিটা জানত শুধু বিষের খোঁজ। তাই সে রাতে ডাকে। রাতে বিষের ঢাকনা খোলে বুকে আর তলপেটের নীচে। মা খিল দিয়ে দেয়, মন্ত্র পড়ে শুদ্ধ করে দেয় সব বিষ।

হরিদেব এখন একা বসে। মা ঢুকে গেছে ছবির ফ্রেমে আবার। পাখিটা নেই। পাখিটার ডাক ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের ভিতর, ওঠানামা করছে সামনের তালগাছটা বেয়ে। কিন্তু হরিদেবের কাছে আসতে পারছে কই? মায়ের তৃতীয় নয়ন পাহারা দিচ্ছে হরিদেবকে। মায়ের তৃতীয় নয়ন ঘিরে উঠছে চাঁদ, সূর্য।

তবু হরিদেব তাকিয়ে আছে চিলের দিকে। মাঝে মাঝে তার নেশা হয়। তখন সে চায়, প্রাণপণে চায় একটা চিল আসুক পাতাল ফুঁড়ে, ঠুকরে দিয়ে যাক তৃতীয় নয়ন। ওই যে চিলটা উঠেছে পাতাল ফুঁড়ে। আসছে তার বাড়ির দিকে। তৃতীয় নয়ন স্থির তাকিয়ে তার দিকে। পুঁই মাচায় এক বিষাক্ত সাপ। হরিদেব চায় না সাপটাকে ধরুক চিল। সে চাইছে ঠুকরে দিক তৃতীয় নয়ন শুধু।

কিন্তু সব গুলিয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়ল হরিদেব। ঘুম ভাঙল যখন ঘন অন্ধকার। হরিদেব ডুকরে কাঁদল। কেউ কোথাও নেই। হরিদেব ভীষণ ক্লান্ত। উঠে দাঁড়ালো। হাঁটতে শুরু করল। সামনে নদী। ওর নীচে গিয়ে শোবে হরিদেব। সব ক্লান্তি ধুয়ে যাবে। হরিদেব নদীর নীচে এসে শুলো। পা, হাত টানটান করে। এখানে কেউ নেই। মাছের দল এসে হরিদেবের গা থেকে সব শোক টেনে টেনে নিয়ে গেলো। হরিদেব চাইছে তার সর্বাঙ্গ ঘিরে জন্মাক পুঁইশাক। তাকে গিয়ে কেউ বেচে আসুক হাটে। বিনা পয়সায়। মুড়ি উড়ে যাক বাতাসে। দুধের মধ্যে পড়ুক পাখিটার ঠোঁট থেকে এক বিন্দু বিষ।

হরিদেব ঘুমালো। শরীরটা তুলোর মত ভেসে থাকল জলের উপর। একটা কাক এসে বসল তার পুরুষাঙ্গের উপর। ডাকল কা.. কা… কা….

নেই... নেই.. নেই

না বিষ, না অমৃত....