Skip to main content

জলের বোতলটা ভরে দাঁড়াতে গিয়ে কোমরে সটকা লেগে গেল। কোনোরকমে নিজের শরীরটা দেওয়ালে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। দমবন্ধ হয়ে আসছে যন্ত্রণায়। স্লিপডিস্ক হল নাকি? কাজের মেয়েটা কাল আসবে না। রাত সাড়ে দশটা বাজে। পাশের বাড়ি টিভির আওয়াজ আসছে। হিন্দি সিরিয়াল চলছে, যেমন চলে। ভাতটা আলগা খাবার টেবিলে। ডাল, ভাজা, পটলের তরকারি সব আলগা। ফ্রিজ থেকে বার করে গরম করে টেবিলে ভাতটা বেড়ে, জলটা নিয়ে খেতে বসবে ভেবেছিল একাত্তর বছরের উমা। উমা রায়। ওয়াইফ অব লেট সুশীল রায়। উনি ব্যাঙ্কে কাজ করতেন। এক মেয়ে যাদবপুরে থাকে, উমা লিলুয়ায়।

উমা ধীরে ধীরে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারটা ধরে এগোলো। সারাটা শরীর কাঁপছে।

উপেক্ষা। উমার চোখ ফেটে জল আসছে। নাতনির আজ রেজাল্ট বেরোলো। একটাবার ফোন আসেনি। উমা করেছিল। ফোন বিজি ছিল। তারপর আর কেউ ব্যাক করেনি। নাতনি হোয়াটসঅ্যাপে স্টেটাসে নিজের রেজাল্ট হাতে মায়ের সঙ্গে ছবি দিয়েছে।

উমা চাইছিল না কাঁদবে। কিন্তু কোমরের ব্যথাটা কাঁদিয়েই দিল। উপেক্ষার কান্না ভীষণ লজ্জার। নিজেকে কেন এত কাঙাল করে ফেলা?

======

লাইট অফ করে শুলো। ঘরে রাস্তার আলো আসছে। সব কিছুর মায়া কাটিয়ে ফেলবে। সব। কিসের মায়া আছে সত্যি? এগুলো সাময়িক। মানুষ ক’দিন কাকে মনে রাখে? এই যে মানুষটা ক্যান্সারে ভুগে চলে গেল? মনে নেই তা তো নয়। কিন্তু কই? কাজ কিছু আটকাচ্ছে? কারোর জন্য কিছু আটকায় না। দুবার তো বেড়িয়েও এলো ট্যুর পার্টির সঙ্গে। একবার কেরল, আরেকবার কাশ্মীর। বরং ওরই যাওয়া হয়নি।

উমা চুপ করে শুয়ে। নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসকে অনুভব করছে। পালস দেখল। দব দব করছে। বুকের উপর একটা ব্যথা বাটখারার মত চেপে আছে। অসহ্য লাগছে। মায়া। সবটাই মায়া।

উমা উঠে জল খেলো। বোতলগুলো মাজতে হবে। গন্ধ হয়েছে। ফোনটা আবার দেখল। স্টেটাসে দেখাচ্ছে। নাতনির হাসিটা তার মত। মেয়েই বলে। জামাইও বলে।

উমা ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বারোটা পঁচিশ। উমা নিজের পায়ের দিকে তাকালো, নাইটিটা দুটো হাঁটুর ফাঁকে টেনে। পা'টা ফুলেছে। ব্যথা আছে। আজ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বসারঘরটা সাজিয়েছে। অকারণ। বিকেলে বেলুড় মঠে গিয়েছিল। আরাত্রিক শুনে এসেছে। তবু ব্যথাটা যায়নি। অস্বস্তির মত বিঁধে আছে। কাটাতে হবে। সব কাটিয়ে যেতে হবে। কাল জয়রামবাটি যাবে। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।

======

উমা ঘরের আলো জ্বালল। গোটা ঘর কারাগারের মত লাগছে। আলমারি খুলে ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। একটা একটা জিনিস ব্যাগে সাজাতে সাজাতে দেখল নিজেকে, আসলেই সাজাতে কত ভালোবাসে উমা সব কিছু। সারাটা জীবন শুধু সাজিয়েই তো এসেছে। তছনছ হয়ে গেলে কেঁদেছে। অভিমান করেছে। আত্মীয়ের উপর অভিমান হয়। অনাত্মীয়ের উপর রাগ। ঈশ্বরের উপর অভিমান।

সাজাতে সাজাতে মনের ভার কমতে শুরু করল। সত্যিই এইটুকু তো সংসার, কেন যে সব আঁকড়ে বাঁচতে চায় মানুষ। নাই বা জানালো তাকে রেজাল্ট। নাই বা মনে রাখল তাকে। নাই বা….

আবার কষ্ট হচ্ছে। নিজের হাতের উপর হাত রেখে বলল, ঠিক হ্যায়….সব চলতা হ্যায়….

=====

রাতে ঘুম হল না। হাওড়া থেকে ট্রেন সকালে। কাউকে না জানিয়ে একা একা এই প্রথম। ট্যাক্সিতে উঠে বুকটা ঢিবঢিব করছে। যদি হোটেল না পায়? ধুর তাই হয় নাকি? সুস্মিতাকে নিয়ে এলে হত? একটা ফোন করবে? থাক। সুস্মিতাও তারই মত। তবে ঝাড়া হাত পা। কেউ নেই কোনো কূলে। থাক। কি হবে? সব কাটিয়েই তো যেতে হবে।

ফোনে রিং হচ্ছে। নাতনি।

উমা ধরল না। বুক মাথা জুড়ে যেন দোল খাচ্ছে কেউ। ধর, ধরিস না… ধর, ধরিস না। উমা ধরল না। আবার ফোন। এবার?

হ্যালো…. দিদুন… শোনো…. তাড়াতাড়ি…. বাবা মা তোমায় সারপ্রাইজ দেবে বলে আজই যাচ্ছে, পুরীর টিকিট কনফার্ম। কিন্তু একটা ঝামেলা হয়েছে, আমি প্যাড নিতে ভুলে গেছি অ্যাজ ইউজুয়াল… মা আবার আমায় বকবে…. ওরা গাড়িতে তেল ভরছে… আমি মাকে কিছু বলব না…. তুমি কিনে নেবে প্লিজ….

কাল তোর মা ফোন করেনি কেন? (বলতে চাইনি। তবু ফস্‌ করে বেরিয়ে গেল। লজ্জায় কানটা গরম হয়ে গেল।)

আরে আমি আর বাবাই মাকে বারণ করেছিলাম… ফস করে বলে ফেলবে... সারপ্রাইজটাই চটকে যাবে…. জানোই তো মাকে…. কিন্তু শোনো না তুমি প্লিজ সারপ্রাইজড হওয়ার ভাণ করবে… আর কিনে নিও হ্যাঁ…  আমার মনে হয় আজ বা কাল থেকেই….

=====

উমা ফ্ল্যাটে ঢুকল। ঠাকুরঘরে গিয়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল। চোখ উপচে জল এলো। কৃতজ্ঞতায়, না ভালোবাসায়, না মায়ায়, না ভক্তিতে বুঝল না।

রান্নাঘরে গেল। এক কাপ কফি দরকার। আর আজকের কাগজটা। এইটুকুই তো। সব কিছু একটু সাজানো থাক, তার মত করে, ছোট্টো পরিসরে, এর বেশি কি চেয়েছিল? কে চায়? খুব বেশি কিছু কি?