কথা হল, সবই তো হল, কিন্তু আসল কথাটা কি হল?
দীর্ঘ আলোচনার পর, বাইকে চড়ে আপিস থেকে ফেরার সময় নন্দলালবাবু ভাবছিলেন, আলোচনাটা কি হল? স্কুলের পরীক্ষায় রবীন্দ্রনাথের সব গান নেওয়া যাবে না। কারণ করোনার অতিমারীতে সব গান শেখানোই যায়নি ঠিক করে। তবে কোন গান রাখা যাবে আর কোন গান রাখা যাবে না এই নিয়ে ভীষণ ঝক্কিতে পড়লেন নন্দলাল।
ট্রেন চলছে না, তাই বাইকেই যাতায়াত করছেন। রাস্তাটাও বড় কম নয়। সন্ধ্যে হব হব। শ্রাবণের মেঘ ছিঁড়ে পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছে রাস্তায়। কিন্তু কি গান রাখা যাবে আর কি গান রাখা যাবে না? এই যেমন এখন মনে পড়ছে, "তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা"... গুনগুন করে গাইতে গাইতে হঠাৎ সুর বদলে এলো, "আজ রাঙিয়ে গেল হৃদয়গগন সাঁঝের রঙে"... আহা মোহরদির গলাটা ভেসে এলো প্রাণে। একটু চা খাওয়া যাক।
নন্দলাল বাইকটা রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে চায়ের দোকানের দিকে নেমে গেলেন। ব্যারাকপুর মোড়ের এই চায়ের দোকানটা ভীষণ প্রিয় নন্দলালের। এক কাপ দুধ চা আর একটা কেক নিয়ে বেঞ্চে বসলেন। "দিনশেষের রাঙামুকুল জাগল চিতে"। এই গানটায় একটা লাইন আছে না, "রাত যেন না বৃথা কাটে প্রিয়তম হে".... না এই গানটা স্কুলে গাওয়ানো হবে না, তবু...আচ্ছা এর মানে কি? রাত বৃথা না কাটা মানে কি? যা ভাবছি তাই কি শুধু?
চায়ের দোকানে এক অল্প বয়েসী মেয়ে এলো। মনে হচ্ছে কোথাও লেবারের কাজ করে। নন্দলালবাবুর বয়েস ছেচল্লিশ। মেয়েটাকে আড়চোখে দেখলেন। তারপর সোজাসুজি মুখের দিকে তাকালেন। মেয়েটা হাসল। নন্দলালবাবুও হাসলেন। ইচ্ছা করছে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে। অনেক কথা, অপ্রয়োজনীয় কথা। সুখের কথা, দুঃখের কথা। বলতে ইচ্ছা করছে বলেই বলবেন।
কিন্তু বললেন না। নন্দলালের মনে অনেক কথা। কেউ শোনে না। এক রবীন্দ্রনাথ ছাড়া। কতদিন হল তিনি গান শেখান আর বাংলা পড়ান। তার কারণও রবীন্দ্রনাথ। বিশাখাকে বিয়ে করলেন। কারণ রবীন্দ্রনাথ। ভারী সুন্দর গায় মেয়েটা। পঁচিশে বৈশাখ জোঁড়াসাকো যেতে চায়। বাইশে শ্রাবণ উদাস হয়। তাদের মেয়ের নাম বেলা। কারণ রবীন্দ্রনাথ।
বাইকটায় স্টার্ট দিলেন। একটা শব্দ মাথায় ঢুকে গেছে - "রাত যেন না বৃথা কাটে প্রিয়তম হে".... রাত বৃথা কাটা মানে কি? বৃথা মানে ব্যর্থ। মানুষ ব্যর্থ হতে ভয় পায়। নন্দলালও পেত। এখন পায় না। এখন জানে ব্যর্থ মানুষ হয়। তাকেও বুক দিয়ে মেনে নিতে হয়। ব্যর্থতাকে ঢাকতে গিয়ে রঙচঙ মেখে বেরোনো পছন্দ করে না বিশাখা। খুব ভালো মেয়েটা। যখন স্কুল সার্ভিসে চাকরিটা হল না, তখন কদিন মন খারাপ করল। ব্যস। সব ঝেড়েফেলে আবার প্রাইভেট নার্সারিতে পড়ানো শুরু করে দিল। বিশাখা বলে সন্তুষ্ট থাকতে সে রবীন্দ্রনাথের কাছে শিখেছে।
নন্দলালবাবুর হেলমেটের সামনের কাঁচটা ওঠানো। হাওয়া আসছে। ভিজে বাদল বাতাস আসছে। রবীন্দ্রনাথ শিখিয়েছেন এই ভিজে বাতাসকেও ভালোবাসতে। এই পৃথিবীকে ভালোবাসতে। এই জীবনকে শ্রদ্ধা করতে। আর শিখিয়েছেন লোভ না করতে। বিশাখা আর তার জীবনের এটা বড় সুর একটা। তারা দুজনেই কেউ লোভী নয়। বেলাও না।
কিন্তু কোন গানটা বাছবেন বা কোন গানটা রাখবেন। রবীন্দ্রনাথের কোন গানটা সোজা আর কোন গানটা কঠিন? ওই যে "খরবায়ু বয়বেগে" গানটায় আছে না, "সংশয় পারাবার অন্তরে হবে পার, উদ্বেগে তাকায়ো না বাইরে"....এই কথাটা কি সোজা? নয় তো। আবার কত সোজা কথাগুলো।
শ্যামনগরের মোড়টা এসে গেল। একটু যেতেই দেখলেন নন্দলালবাবু বেলা আর বিশাখা ছাদে পায়চারি করছে। নন্দলালবাবুর মনে হল, "বৃথা" শব্দটার মানে জেনে গেছেন। এদের দুজনকে ছাড়া তার জীবন বৃথা। কোনো মানে নেই। ঝাপসা হল চোখ। বৃষ্টি নামল। নন্দলালবাবু হেলমেট খুলে বাইকটায় কোমর ঠেকিয়ে দাঁড়ালেন। শ্রাবণের ধারায় চোখের জল ভাসিয়ে দেবেন। এইটুকুই তো তাঁকে দেওয়ার। "অন্তরে মোর তোমার লাগি একটি কান্নাধন"। আর কি চাই!