Skip to main content
       যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে স্যার বলছেন, দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনা হতে, সুখেষু বিগতস্পৃহ।
       দুঃখে উদ্বিগ্নতা থাকবে না। সুখের প্রতি স্পৃহা না।
 
       স্যার, হেব্বি কঠিন। আপনি কেসটা বুঝুন, কুরুক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আপনি অর্জুনের কাউন্সেলিং করছেন, অর্থাৎ অর্জুন এটুকু অন্তত জানে তার পক্ষে কে আর বিপক্ষে কে। আমাদের তো স্যার সেটা নিয়েও ক্যাঁচাল, কে যে আমার পক্ষে আর কে যে বিপক্ষে, বড্ড গোলমাল হয়ে যায় স্যার। এমনকি নিজেও যে কোন পক্ষের তাও বুঝি না, আপনাকে বুঝিও না।
       বড্ড ঘাঁটা অবস্থা স্যার। এই যে নিরুদ্বেগ থাকার কথাটা বলছেন, মনটাকে প্রদীপের শিখার মত স্থির, সে বড্ড কঠিন স্যার। আপনি যদিও বলছেন অভ্যাস আর বৈরাগ্যে স্থির হবে, আমিও আশা রাখি হবে, কিন্তু কবে যে হবে? "কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব তোমার রসাল নন্দনে"।
       বৈরাগ্য হবে না। আর কিছু না হোক বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা যে কিছুতেই সরে যায় না। প্রতিদিন হাজার জ্বালা যন্ত্রণা মান অপমান ব্যর্থতার পর আবার নতুন করে বাঁচার সাধ যে যায় না স্যার। বারবার আপনার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলতে ইচ্ছা করে, আমায় আরেকটা চান্স দেবেন স্যার? ভীষণ ইচ্ছা করে ভালোভাবে বাঁচার। সুখে, বিলাসিতায় নয় স্যার, শান্তিতে। সুখ কি চাইব স্যার, চারদিকে যা দেখছি আমি বুঝতে পারছি হয় আপনার সুখের বাজেট ফেল করছে নইলে আপনার অন্য কোনো ভাবনা আছে, নইলে এত দুঃখ অশান্তি মানুষের কেন?
       ওই দেখুন, কেমন একটা আকাট মুর্খের মত কথা বলে ফেল্লুম। দুঃখ আর অশান্তি কি এক কথা? আমি অনেক দুঃখী শান্ত মানুষ দেখেছি, আবার সুখী অশান্ত উদ্বিগ্ন মানুষ দেখেছি। তাই বলছিলাম স্যার, আমি জানি এ সংসারে সুখের ব্যবস্থায় গরমিল আছে। আপনি অবিশ্যি সে নিয়ে দ্বিমত নন, "অনিত্যম অসুখম লোকম" বলে থুয়েছেন আগেই, অর্থাৎ কিনা এ জগত অনিত্য ও অ-সুখের আগার। কি করে হল আপনাকে জিজ্ঞাসা করব না, বাড়ি বাড়ি দেখছি, শিব গড়তে বাঁদর চতুর্দিকে। মানুষ নিজেকেই নিজের মনের মত গড়ে তুলতে পারছে না, সুখের আশায় ঘর বেঁধে জ্বলেপুড়ে মরছে, এ তো হরদম দেখছি স্যার, আপনিও একই কেস খেয়েছেন বুঝছি।
       কিন্তু শান্তিটা কি করে পাই স্যার? শান্তির বিপরীত শব্দ উদ্বিগ্নতা, দুঃখ তো নয়, সে বুঝি স্যার, কিন্তু মন নিরুদ্বিগ্ন হবে কি করে স্যার? সারা জীবন তো স্যার ঝুলন্ত ব্রীজে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। না তো হলাম সম্পূর্ণ জড় না হলাম সম্পূর্ণ চেতন, মাঝামাঝি দুলেই গেলাম। মানুষ মরণশীল। কিন্তু মানুষের সাধ তো স্যার মরণশীল নয়। আচ্ছা স্যার সাধ মানে কি আত্মা? না, তা তো নয়, আত্মা তো আপনি বলছেন নিত্য-শুদ্ধ-মুক্ত স্বভাব, তার কেন কামনা বাসনার সাধ থাকবে? তবেই বুঝুন, না হলাম পাথর, না হলাম বাতাস। না হলাম গর্দভ, না হলাম দেবতা। দুলেই যাচ্ছি স্যার।
       তবু স্যার, দুঃখী হই, কিন্তু অশান্ত যেন না হই, এই ফর্মুলাটা আমার মনে বেশ ধরে স্যার, মাঝে মাঝে পারি, আবার মাঝে মাঝে বালিঝড়ের সব ঘেঁটে যায়। তা যাবে না? ভালোবাসা থাকবে আর উদ্বিগ্নতা থাকবে না তা কি হয় স্যার? ভালোবাসা মানেই যে মুঠোর উষ্ণতা, মুঠো খুলে ভাসিয়ে দিই কি করে স্যার? সব যে যায়! ওই বললাম, আমায় যে আজন্ম ঝুলন্ত কম্পমান সেতুতে দাঁড় করিয়ে রাখলেন স্যার। ভালোবাসার শিকড় বুকের ভিতর অবধি চারিয়ে গেল, আপনি বললেন এবার উপড়ে ফেল। আপনার কথার তো অন্যথা হওয়ার যো নেই স্যার, কিন্তু কত রক্ত দিয়ে সে শিকড় সেচেছি বলুন, সব ফুরিয়ে গেল! আপনি নিষ্ঠুর স্যার! ভীষণ নিষ্ঠুর। আমি ভীষণ আত্মাভিমানী স্যার। সুখের চাইতে গভীর আমার আসক্তি আমার নিজেকে নিয়ে নিজের অভিমানে স্যার। তাই যন্ত্রণা যতটা শূন্যতার, তার চাইতে বেশি হেরে যাওয়ার স্যার। শূন্যতার দুঃখের কারাগারে ক্ষুব্ধ আত্মাভিমানের বাদুড়! আর বাদুড় থাকলেই তার বিষ্ঠার দুর্গন্ধ তো থাকবেই, আছেও।
       স্যার, আমায় আপনি এই ঝুলন্ত সেতুতে দাঁড়ানোর কৌশলটা শিখিয়ে দিন। প্লিজ বলুন, কি করে আমি স্থির থাকব। দুঃখ নেব হাত পেতে উদ্বিগ্নতায় হাত কাঁপবে না। কি করে হবে স্যার? আপনি আছেন স্যার? এই ভরসায়। এই সেতুতে থেকে যদি পড়ি ধরে নেবেন স্যার? এই বিশ্বাস ছাড়া বাকি তো কিছুই নেই স্যার। এত সুখ-দুঃখ-ক্রোধ-হিংসা-আশা-বাসনা-সংশয়-বিশ্বাস-তত্ত্বতালাশ... এ সবের শেষে কি স্যার? সেই তো অন্ধকার মৃত্যু। আপনি নিজেকে মহাকাল বলেছেন। যে মহাকাল আমাদের অজ্ঞানতায় অন্ধকার স্যার। আমরা কত লক্ষকোটি বছর পর কোন নক্ষত্র মহাকাশের কোন আঙিনা পেরোবে বলে দিতে পারি স্যার, কিন্তু এই ঝুলন্ত সেতুতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কে কবে খসে যাবে, কেঁদে উঠবে, হেসে লাফিয়ে হাততালি দিয়ে উঠবে, গলায় দড়ি দিয়ে দেবে - বলতে পারি না স্যার। আমাদের মধ্যে একটা গভীর অন্ধকার। প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার। আমরা এ জড় বিশ্বের অণু-পরমাণু জ্ঞানের আলোকে আলোকিত করে ফেলছি স্যার, কিন্তু নিজেকে জানার ভাঁড়ার শূন্যই থেকে যাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে সব বড় জটিল হয়ে যাচ্ছে। নিজের ভিতরের এই অন্ধকারকে কেউ বলে শূন্য, কেউ বলে পথ, কেউ কোনো একটা তত্ত্ব খাঁড়া করিয়ে বলে সেই নাকি "আপনি" - গড। সেই নিয়ে কত গোল স্যার। আমি জানি আমার ভিতরের অন্ধকার পথ স্যার, অনন্ত পথ। আলো আছে কিনা জানি না, কিন্তু আলোর প্রতি তৃষ্ণা আমার আছে। তাই প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী বিশ্বাস করি তৃষ্ণা যখন আছে তার নিবারণের ব্যবস্থাও নিশ্চয় আছে। নইলে সবটাই যে ফাঁকি হয় যায় স্যার।
       অনেক কথা বললাম, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ স্যার, শুভ জন্মদিন। যদিও জানি পথের কোনো নিজস্ব জন্মদিন হয় না, পথ জন্মায় সেদিন যেদিন পথিক এসে পথে দাঁড়ায়। সেদিন ব্যাসদেব এসে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ আমরা। এ তো চলতেই থাকবে স্যার। আমায় শুধু আপনি দুঃখের গায়ে লেগে থাকা উদ্বিগ্নতার ট্যাগটা খুলে ফেলতে সাহায্য করুন। আমি দুঃখী হই, আপত্তি নেই, অশান্তিতে মাতাল যেন না হই। ঝুলন্ত কম্পমান সেতুতে যেন স্থির চিত্তে বলতে পারি নিজেকে - আমি আছি, আছি আছি, চিরকালের জন্য নয়, এই ক্ষণকালটুকু নিয়েই আছি, বুদবুদের মত, জন্ম-মৃত্যুহীন চৈতন্য সাগরে - এই সত্যি।