Skip to main content

 

"তোমার এত জোরে কথা বলার কী দরকার ছিল?"

"হ্যাঁ বাবা, সবতাতে তোমার বাড়াবাড়ি..... "

টোটো থেকে নামল মেয়ে আর মা। টোটোচালক কাঁচরাপাড়া স্টেশানের পুবদিকে টোটোটাকে স্ট্যাণ্ড করে নামল। রাত অনেক হল। শান্তিপুর লোকাল আসছে। "হোয়্যার ইজ মাই ট্রেন" অ্যাপে দেখাচ্ছে দশ মিনিট লেট হবে। এগারোটা বেজে গেছে। বৃষ্টি হল যা। চারদিক জল থইথই।

তোমরা এগোও, আমি টিকিটটা দৌড়ে কেটে আনি.....

মেয়ে বলল, থাক....তুমি যাও.....

বউ বলল, খেয়ে নিও......

ওরা দু নাম্বার প্লাটফর্মে উঠে গেছে। হাঁটছে। টোটোটা স্ট্যাণ্ড করে দাঁড়িয়ে মধ্যবয়সী পুরুষ। মেয়েটা পড়তে আসে কাঁচরাপাড়ায়। সপ্তাহে তিনদিন। ফিরতে এরকমই রাত হয়ে যায়। চিন্তা হয় না। আজ হচ্ছে। সবাই যা বলছে। আজ ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।

শান্তিপুর লোকালটা ঢুকল। অন্যদিন তাকায় না। আজ তাকালো। মেয়ে নেই তা নয়। আছে। ঘন্টা দুএক আগে কাঁচরাপাড়া মার্কেটে ছিল। একটা কেক-প্যাস্ট্রির দোকানে উপচে পড়া ভিড়। কেউ বিমর্ষ না। সেখানেও ভর্তি মেয়ে। কেউ ভয় পাচ্ছে না। কিন্তু তবু যেন কোথাও ভয় আছে। সবাই দেখতে পাচ্ছে না। নইলে এত এত বড় বড় মানুষ ভয়ের কথা বলবে কেন?

দুই দিদি কল্যাণী নার্সিংহোমে আয়ার কাজ করে। নিজের মায়ের পেটের দিদি না। ওই আরকি। লতায় পাতায়। টোটোতে বসে বসেই ফোন করল। বড্ড উদ্বেগ লাগছে। অনেকদিন কথা হয় না। দুজনেই রাতটা নার্সিংহোমেই কাটায়। বাড়ি সেই রাণাঘাট ছাড়িয়ে অনেক ভেতরে। সপ্তাহে একবার বাড়ি যায়।

"আরে ধুস! আজকে থেকে এই কাজ করছি নাকি....ভাবিস না তুই.....মনা ভালো আছে? কোন ক্লাস হল? ইলেভেন? সায়েন্স নিয়ে পড়ে? ডাক্তার হবে? দেখিস বাবা.....যা ঘটছে.....আরে না না....এই বয়সে আবার কী কাজ নেব....কিছু হবে না.....তুই কি কাঁচরাপাড়াতেই কাজ করিস?....হ্যাঁ হ্যাঁ আসব রে....তুইও তো দেখা করতে পারিস একবার....নিশ্চয়ই এদিক আসিস ভাড়া নিয়ে.....আরে ভাবিস না....ভালো লাগল তুই কল করলি.....আরে না....আমরা কত রাতে বাড়ি গেছি এসেছি বল তো.....চিন্তা হবেই....এরকম একটা ঘটনা.....তবু ভাবিস না.....আসিস......"

======

মেয়েটা ট্রেনে উঠে হাত নাড়ল। কী করবে? ডাক্তারি পড়াবে না? ওর মা অত বোঝে না। ওসব নিয়ে ভাবেই না। ফিজিওথেরাপির কাজ করে। আচ্ছা সেও তো কত রাত করে বাড়ি ফেরে.....সোদপুর...বারাকপুর থেকে কাজ করে যেদিন ফেরে......এখন অবশ্য যায় না....বাড়ির সামনে একটা ছোটো বারান্দা একজন ভাড়া দিয়েছে.....সেখানেই করায়.....কিন্তু মেয়েটা? পড়াবে ডাক্তারি?..... থাক....বরং কাঁচরাপাড়া কলেজ, কি নৈহাটি কলেজে কিছুতে একটা অনার্স নিয়ে নেবে.....কিন্তু কথাটা বলবে কী করে? মেয়েটা তো বাড়ি মাথায় করবে......

=======

ভোর হল। চমকে উঠে দেখে সে টোটোতেই বসে বসে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে সারারাত। উঠেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে অন করল। "পৌঁছিয়েছি ঠিকঠাক। খেয়ে নিও। সকালে কল করবে মা"।

পাশেই একটা কালী মন্দির। টোটো থেকে নেমে মন্দিরের সামনে দাঁড়ালো। মা তাকিয়ে আছেন তার দিকে। মেয়েটাকে নিয়ে কী করব মা? কী করব? পড়বে মেয়েটা?

মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল।

"দাদা, কাঁপা মোড় যাবেন?

চেনে তাকে। মেয়ে। কিন্তু আসলে মেয়ে নয়। পুরুষ ছিল। কলকাতা থেকে ফিরছে। রোজ যায় কলকাতায়। রাতের ট্রেনে। এখন তার সাজটা ম্লান। সারা চোখে মুখে ক্লান্তি। যেন এখনই ঘুমিয়ে পড়বে রাস্তায়।

মায়ের দিকে তাকালো। মা বাসি মালা জড়িয়ে গলায়, দাঁড়িয়ে, বলল, নিয়ে যা।

সূর্য উঠছে। মেঘের মধ্যে ঢাকা। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা পড়বে ডাক্তারি। সাহস দিতে হবে। এভাবে হারিয়ে গেলে হবে না। কাউকেই হারিয়ে যেতে নেই। মেয়েটা নেমে ভাড়া দেবে। সে তো নেবে টাকাটা। তার দরকার। দরকারের বাছবিচার হয় না। সবাই বেরোক রাস্তায়। সবাই বেরোক। ভয় নয়। বাস্তব ভয়কে মাড়িয়েই। ঘরে বসে বোঝা যায় না। রাস্তায় নেমে দাঁড়ালে বোঝা যায়। নীচের দিকে তাকালে বোঝা যায়। স্রোতকে আটকানো যায় না। শৌখিনতাকে বাঁধা যায়। তার মেয়ের স্বপ্নটা তো শৌখিনতা নয়। তবে? মেয়েকে সে নীচের দিকে তাকাতে শেখাবে। যেখানে মানুষের নিত্য মিছিল। স্লোগান ছাড়া। নিত্য প্রয়োজনের তাগিদ যেখানে। ও দেখলে ভয় কাটে।

মেয়েটা এগিয়ে যাক।