"আজ রুটি করতে ইচ্ছা করছে না... তরকারি সকালের যা আছে হয়ে যাবে... বাজার থেকে একটু রুটিটা নিয়ে চলে আসবে?....."
দুটো ঘর। চার-পা বেশি হাঁটলেই দেওয়াল। বারান্দা মানে সরু গলি। খোলা হাওয়া বলতে বড় রাস্তায় খেলে বেড়ানো হাওয়া সরু গলিতে ঢোকে যেটুকু, সেটুকুই। কালো-নীল ছাপ ছাপ একটা নাইটি আর লালে কালো ফুল আঁকা একটা নাইটি - এই দুটোতেই নিজেকে দেখতে দেখতে চোখে অন্য রঙ যেন আর সহ্য হয় না রাখির।
সাইকেলটা দেওয়ালে হেলান দিয়ে রেখে সেটাকে চেন-তালা দিয়ে জানলার সাথে বাঁধতে যাচ্ছিল জিতু, রুটির কথাটা শুনে সাইকেল ঘোরালো। মনে মনে হিসাব করল চারটে আর তিনটে সাতটা আর দুটো দুটো মানে এগারোটা। দশটাই নিয়ে আসা যাক। তিরিশ টাকা। পকেটে রাখা মানিব্যাগের দুটো গর্ত মনে করল --- চারটে দশ, একটা পঞ্চাশ, আর একটা একশো। একশোটা একটু ছেঁড়া, ওটাই চালাতে হবে।
রাখির শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। গন্ধ পাচ্ছে না। স্বাদ নেই। পায়খানা হচ্ছে বারবার। জানে করোনা। কিন্তু টেস্ট করাতে যেতে চাইছে না। জিতুরও হয়েছিল কয়েক সপ্তাহ আগে। এখন শুধু দুর্বলতাটা আছে। না তা না, শ্বাসকষ্টটাও হয়। একটু জোরে সাইকেল চালালে বুকটা চাপ হয়ে যায়। যেন আর বাতাস ঢুকবে না। বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে। যখন তখন মাথাটা চক্কর দেয়। কিন্তু টেস্ট করালে বিপদ। মিউনিসিপালিটি থেকে এসে কাগজ আটকে দিয়ে যাচ্ছে কাঁচরাপাড়ায় - করোনা পজিটিভ। রাখির কাজটা যাবে। খাবে কি? জিতু বড়বাজারে সোনার দোকানে কাজ করত। কত মাস হল বসা! ট্রেন নেই। যাবে কি করে? এখন এটা ওটা করে কাজ চালায়। হয় না। ওতে কি চলে? কিচ্ছু না। দুটো যমজ বাচ্চা। ছ'বছরে পড়ল। অনলাইন ক্লাস করাচ্ছেন দিদিমণি। কিন্তু নেট ভরার টাকা কই? সে নিয়ে ভাবে না জিতু। কিন্তু রাখিটার চোখ-মুখ বসে যাচ্ছে, কি হবে কে জানে।
রুটির দোকানে ভিড়। মাস্ক পরে নেই কেউ। প্রথম প্রথম বুঝতে পারেনি জিতু। শুধু জ্বর এলো। আর পায়খানা। পিঠটা অসহ্য ব্যথা। ভাবল, কয়েকদিন ঘোষেদের গোলায় বালির লরি খালাস করার কাজ করছিল তাই হবে হয় তো। কিন্তু এত দুর্বলতা? মাথাটা টাল খাচ্ছে। হেঁটে মোড়ের দোকান অবধি যাওয়া যাচ্ছে না। এত জ্বর তো নেই! ডাক্তারের কাছে গেল না। ভয়ে। পাছে টেস্ট করতে পাঠায়। মনে যা ভয় ছিল তাই হল। তিনদিন পর নাকে গন্ধ নেই। রাখিকে বলল না। ভয় পাবে। ইচ্ছা করে একটু দূরে দূরে থাকতে লাগল। কিন্তু এত ছোটো ঘরে কতটা দূরে থাকা যায়। রাতে বাথরুম করতে উঠলে চোখটা টিউবলাইটের মত দবদব করে। বমি পায়। জিভ শুকিয়ে যায়। একটু পরিশ্রম হলেই দরদরিয়ে ঘাম, এমনকি কথা বলতে গেলেও। মারা যাবে? মাঝরাতে উঠে ঘুমন্ত মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। সে চলে গেলে কি হবে? রাখি চারটে বাড়ি কাজ করে, পাঁচ হাজার পায়। চলে না, চালিয়েই নিতে হয়।
"ক'টা দেব জিতু?"
জিতু অন্যমনস্কভাবেই বলল, এগারোটা...
দাম দেওয়ার সময় মনে পড়ল তার একটা রুটি কম খাওয়ার কথা ছিল। তেত্রিশ টাকা।
বাড়ি ফিরে দেখল রাখি শুয়ে আছে বিছানায়। ঘুমিয়ে পড়েছে। জিতু স্নান করতে ঢুকল। ছেলে দুটো পাশের বাড়ি টিভি দেখতে গেছে। যাক। নইলে সন্দেহ করবে। কোনো অন্যায় করছে না তারা। তাদেরও সব আছে। কিন্তু তাদের কেবলের টাকা দেওয়া হয়নি। বন্ধ টিভির স্ক্রিণে রাখির ঘুমন্ত শরীর, ক্লান্ত।
জিতু স্নান করে বেরিয়েও দেখল রাখি ঘুমিয়ে। বুকটা ছ্যাঁৎ করল। নাকের কাছে হাত আনল। না, বেঁচে।
জিতু রাখির পাশে শুলো। রোগটা কে এনেছে বাইরে থেকে? সে, না রাখি? জিতু রাখিকে জড়িয়ে শুলো। খুব ইচ্ছা করে গোটা পরিবার তারা দম আটকে মরে যাক। পৃথিবীটা আর আগের মত হবে না। কোনোদিন হবে না। ছেলেগুলো ভিক্ষা করবে? পড়াশোনা শেখাবে না? কি করে হবে সব?
রাখি চোখ খুলে তাকালো। তাকে দেখেই ধড়ফড় করে উঠে বসল।
কখন এলে?
ভিজে চুলে হাতের আঙুল ঢুকিয়ে বলল, স্নানও হয়ে গেছে?
হুম...। জিতু চোখ বন্ধ করে শুয়ে। রাখি কি মরে যাবে? এই সময়ে ভালো খেতে বলছে সবাই। কি খাবে? রাখির হাঁপানি। মরে যাবে? যাক। ছেলেদুটোকে মামার বাড়ি রেখে যে দিকে দু'চোখ যায় চলে যাবে।
এই শোনো।
রাখি পাঁজরে খোঁচা দিল।
জিতু চোখ খুলে তাকালো।
আজ বিকাল থেকে গন্ধ পাচ্ছি... বেশি না... অল্প....
জিতু'র মুখটা আনন্দে জ্বলে উঠল। তড়াক করে উঠে বলল, তাই?
রাখি মরবে না তবে। অথচ একটু আগেই কি যেন চাইছিল... ওই এগারোটা রুটির মত...
জিতু আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। অল্প অল্প শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আনন্দে। উত্তেজনায়। রাখি পাশে থাকলে সে সব পারে। রাখি তার বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে।
জিতু জিজ্ঞাসা করল, শ্বাসকষ্ট?
রাখি বলল, অল্প অল্প...
জিতু বলল, কাজে যেও না ক'দিন....
রাখি হাসল, চা খাবে তো....
জিতুর শ্বাসকষ্টটা বুক খামচে ধরল। কান্না পাচ্ছে।