অসম্ভব ভিড়, বারাকপুর স্টেশান। ধাক্কা দিয়ে এগোনোই যায়। কিন্তু এগোলেন না। পিঠে, বুকে, মুখে ধাক্কা খেতে খেতে একবার ছাদের দিকে তাকালেন। পায়রাগুলো গিজগিজ করছে। সন্ধ্যের সময় প্রতিদিন হয়। তবে আজ অন্যরকম। কেন অন্যরকম তা জানেন না। আজ সারাদিন না ভাবতে চেষ্টা করেছেন। এখনও করছেন।
আজ ১১ সেপ্টেম্বর। স্বামীজির শিকাগোর স্পিচের দিন। আজ স্কুলে এই নিয়ে আলোচনা, বক্তৃতা হল। তিনি নিজেকে রিলেট করতে পারলেন না। তখনও ছাদের দিকে তাকিয়েছিলেন। ঝুল, চারটে ইলেক্ট্রিক পাখা, টিউবলাইটগুলো দেখতে দেখতে ভাবছিলেন, ওদের কিছু বলার থাকলে কি বলত? ওনার মত হাই তুলত? ওনার মাথার মধ্যে মনে হচ্ছে যেন কে চাদর পাল্টাচ্ছে। তোষকটায় চায়ের দাগ, গুচ্ছের ফুটো, সেটার উপর দিয়ে নতুন চাদর পাততে চেষ্টা করছে যেন কেউ। আচমকা হাততালির আওয়াজে চমকে উঠে হাততালি দিলেন, প্রথমে মনে হল কেউ যেন গোল দিল... তারপর মনে হল, না হেডমাষ্টারের স্পিচ চলছিল, "স্বামীজী ও যুবসম্প্রদায়"। কেউ শুনছিল না, সেল্ফি, নীচু মাথা হাতে জ্বলন্ত টাচ ফোন।
ট্রেনের গোলমাল। কেন গোলমাল খোঁজ নেবেন না। আজ অঙ্ক করাতে ভালো লাগেনি ক্লাসে। সব উত্তরগুলো জানা হয়ে গেছে। জানা উত্তরের অঙ্ক বেশিদিন করানো যায় না। মনে হয় সব্বাইকে ঠকাচ্ছেন। সবাইকে ঠকাচ্ছেন। তিনি কোনোদিন বেশ্যাবাড়ি যাননি, মদের ঠেকে যাননি, ঘুষ নেননি, মিথ্যাকথা অবশ্য বলেছেন, কিন্তু তেমন জাঁদরেল মিথ্যা বলা হল কই? স্বামীজী বলেছেন, গরু মিথ্যা কথা বলে না, তবু গরু গরুই থাকে। তিনি গরুর অধম। তার অবদমিত কাম নেই। বাড়িতে একছেলে একমেয়ে। সবাই সামাজিক। তার স্ত্রী, শ্বশুরবাড়ি, নিজের বাড়ি সবাই সামাজিক, ভদ্র।
প্ল্যাটফর্মের নীচে পায়খানার দাগ। পায়রার পায়খানা। সব ধর্ম সমান হলে কি হয়? কোনো ধর্মের সাথে কোনো পার্থক্য হলে মানুষের সুবিধা বেশি, না এক হলে? ঈশ্বর পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী। দেবীর বোধনের নেপথ্যেও পুরুষ। সমাজে পৃথকত্বের দায় বেশি নারীর না পুরুষের?
আবার ভাবনা। থাক। একটা বাচ্চা, উবু হয়ে বসে একটা বাটিতে সাদা ভাত আর উপরে একটা আলুর চপ নিয়ে, খাবে। পায়রার পায়খানা বাঁচিয়ে বসে আছে কোনে। পাশে ওর মা ঘুমাচ্ছে। শরীরটা প্যাণ্ডেলের ফেলে দেওয়া বাঁশের মত গুটিয়ে সবার ব্যস্ত পা বাঁচিয়ে। স্বামীজীর মঠ আছে, স্বামীজীদের মঠ আছে, ধনী ভক্ত আছে, মুমুক্ষু ভক্ত আছে, স্বদেশপ্রেমী ভক্ত আছে, এরা কার? এরা বাণী। এরা দরিদ্রনারায়ণ। এদের ভিতর শিব, বাণী বলছে, সেবা চাইছেন। বোনাস হয়নি এখনও, কে সেবা আনবে। কোন ক্লাব, কোন রঙ? কেমন শিব, রুগ্ন না স্বাস্থ্যবান?
ট্রেন আসছে। হেডলাইটের আলো স্পষ্ট হচ্ছে। পায়ের হাতের মাংসপেশিগুলো টানটান হচ্ছে। শরীরের প্রতিক্রিয়া। ঝাঁপ দিতে হবে। সবাইকে ঠেলে উঠতে হবে। ব্রহ্মের সাথে ব্রহ্মের ভিড়ে কত ব্রহ্ম ছিটকে পড়বে। সব মায়া। সব লীলা। অনন্ত আত্মা বুকে দগদগাচ্ছে, লেডিসটা পার হয়ে গেল, চতুর্থ বগির প্রথম দরজা, লাফ... লাফ...
ঘামের গন্ধ, ভিড়ের চাপ, পায়ের উপর কেউ দাঁড়িয়ে... সিস্টার্স অ্যাণ্ড ব্রাদার্স অফ... লোকাল ট্রেন.. দাদা সরে দাঁড়াবেন একটু... খিস্তি.... চোখের মাথা খেয়েছেন... দাঁড়াবার জায়গা নেই... ব্রহ্ম হতে কীট পরমাণু সর্বভূতে সেই প্রেমময়... ক্লান্ত ব্রহ্মরা... শিশ্নোদরপরায়ণ... স্মার্টফোন আর পলিসি সম্বলিত জীবন... ঈশ্বর... ধর্ম তুমি সহনশীল হও.. মানুষ তুমি সহনশীল হও... মানুষ বড় কাঁদছে... তুমি মানুষের পাশে দাঁড়াও.. এতো শক্তি... থাক... সব মিলিয়েই মানুষ... মানুষ মানুষ আর মানুষ... প্রসূতিঘর থেকে শ্মশান শুধুই মানুষ.... তোমার তাজমহল... রঙ চটছে... তবু মার্বেল তো, টিকে যাবে... ট্রেনের গতির ছন্দ আছে, মানুষের কথার ছন্দ আছে, তাকানোর ছন্দ আছে, ভালোবাসার ছন্দ আছে... বাদামওয়ালা দাঁড়াও আমি দেখব তোমায়... বাদাম পরখ করব না, তোমায় দেখব.. আমি দেখতে ভুলেছি... আমায় দেখতে শিখতে হবে.. শুধুই দেখতে.... জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকছে.. ক্লান্ত বন্ধ চোখ মানুষের দল বাঁচতে চাইছে... শুধুই বাঁচতে চাইছে... আকাশের মত না, মাটির সুরে বাঁচতেই চাইছে..... শান্তি শান্তি শান্তি.. আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি... তোমার চোখে মানুষের উপর বিশ্বাস... শুধুই... মানুষ.... মানুষ... মানুষ...