সমস্যা হল ইঁদুর নিয়ে। জানি তিনি সিদ্ধিদাতার বাহন। কিন্তু কথা হচ্ছে পারমার্থিক ইঁদুর আর জাগতিক ইঁদুর তো আর এক কথা না রে বাবা। আলমারির তলা থেকে খাটের তলা। খাটের তলা থেকে টেবিলের তলা। আরে কখন পায়ের তলায় এসে পড়বি... ভয় নেই প্রাণে! রাত এগারোটা পনেরো।
বিবেকচূড়ামণি টেবিলে রেখে, শঙ্করাচার্যকে অক্সফোর্ডের অভিধানে চাপা দিয়ে, হাতে টর্চ নিয়ে খাটের তলায় উঁকি দিলাম। একেই বলে কর্মফল। কোথায় পঞ্চকোষ ছাড়িয়ে আত্মা আর ব্রহ্মের একত্বের বোধ হব হব করছিল, ইনি এলেন মাঝখান থেকে। ওই শঙ্করাচার্য লিখছেন না, দেশ-কাল সহায় না হলে হয় না। সত্যিই হয় না। কোথায় আত্মান্বেষণ, তাই ছেড়ে কিনা মূষিকান্বেষণ! অগত্যা যা থাকে কপালে। ঘাড় হেঁট করে মাথা নীচু করে মেঝেতে গাল ঠেকালাম। যে মাথা এতক্ষণ শঙ্করের প্রবল প্রজ্ঞার কাছে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল, সে কিনা এখন এক ইঁদুরের জন্য এইভাবে ভূলুণ্ঠিত? হয় হয়, সময় মানুষকে দিয়ে কি না করায়।
খাটের নীচে অন্ধকার। অবিদ্যার অন্ধকারে ভয় আমার নেই, অন্তত সেই অন্ধকারে মাকড়সা নেই, কিন্তু এ অন্ধকার যে তার চাইতেও ভয়ানক! অবিদ্যার জন্য না হয় আরো কয়েক জন্ম সহ্য করে নেব, কিন্তু খাটের তলার এ অন্ধকারে ঢুকতে গেলে যদি মাকড়সা, কিম্বা বিছে, কিম্বা একটা হেলে সাপ! আহা, এক খাটের তলায় এতকিছু থাকতে পারে নাকি! একি পিসি সরকারের যাদুঘটি নাকি!
গালে মেঝে ঠেকিয়ে, নাকের সামনে টর্চ জ্বেলে শুয়েই আছি, খাটের তলায় আদিম অন্ধকার। কই? কিচ্ছু তো নেই! লুকিয়ে গেছে। কি জীবন মানুষের! ঈশ্বর ধরতে যাও, তিনি লুকিয়ে, ইঁদুর ধরতে যাও, তিনিও লুকিয়ে। একজনের মানের ভয়, আরেকজনের প্রাণের। যা হোক। আবার এসে চেয়ারে বসলাম। টেবিল থেকে বই নিয়ে চিহ্নিত পাতায় দৃষ্টিপাত করেছি কি করিনি, আবার! সামনেই। একটা মুড়ি টুক্ করে খেয়ে ঢুকে গেল কম্পিউটারের টেবিলের তলায়। কি করব, মারব? কাল বিষ আনব? খাঁচা আনব? হাতে বই, মন আত্মতত্ত্ব ছেড়ে মূষিক আবদ্ধকরণ তত্ত্বে ব্যস্ত। যত বলি, ওরে বাছা, সম্পূর্ণ জগত যদি মিথ্যা হবে, তবে ওই ইঁদুরটাই কি বাদ যাবে, সেও তো মিথ্যা।
মন বলল, কিন্তু কামড়ালে? যদি রেবিস হয়?
আমি বললাম, আহা, ইঁদুরে রেবিস হয় নাকি!
মন বলল, আচ্ছা ভাইরাস কি ব্রহ্ম?
আমি বললাম, জানি না। শংকর কি জীবাণুর কথা জানতেন?
মন বলল, তবেই ভায়া, তুমি আপাতত আমায় রক্ষা করো ইঁদুরের হাত থেকে, তারপর আত্মতত্ত্ব আলোচনা করো। শরীর গেলে তুমি না হয় আত্মা হয়ে ঘুরে বেড়াবে, আমি কোথায় যাব বলো?
খুব সংশয়ে পড়লাম। গতকালই মহান বৌদ্ধ সন্ন্যাসী শান্তিদেবের Way to Bodhisattva পড়ছিলাম, সেখানে বলেছে আত্মা বলে কিস্যু হয় না। এদিকে আবার শংকর বলছে আত্মাকে না জানলে নাকি মানবজন্মের জামানত বাজেয়াপ্ত। কই যাই?
মন বলল, ওহে কি ভাবো এত, ব্রহ্ম সত্য কি অসত্য সে বিচার পরে করা যাবে ভায়া, আপাতত ইঁদুর যে সত্য এ নিয়ে তো দ্বন্দ্ব নেই!
তা নেই, কিন্তু করব কি? আত্মা থাকুক চাই না থাকুক, কিন্তু জীবহিংসা যে ভালো কাজ নয় সে তো সবাই বলেছে।
মন বলল, তোমায় হিংসা কে করতে বলছে ভায়া, তুমি শুধু মারবে। মারা মানে হিংসা না, কর্তব্য।
আমি বললাম, অহিংসা পরমোধর্ম।
মন বলল, সে আমি মানি। কিন্তু ইঁদুর তো সামান্য ইঁদুর, ওকে মারাই যায়। সেকি হাই প্রোফাইল কিছু? না তো। এ তো সামান্য ইঁদুর, এ তো ধর্ষক নয় যে থানা থেকে একটা বাচ্চাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করবে আর তুমি তার প্রতিবাদ করে দেশ মাত করবে। তবে বলতাম অন্যায় করছ। কিম্বা জঙ্গলে আদিবাসী কি দলিত কাউকে ধর্ষণ করে মেরে বা মরার উপযুক্ত করে ফেলে রেখে যাবে আর তুমি তার জন্য সারাদেশ জুড়ে প্রতিবাদ করবে। সেগুলো হিংসা, কোরো না সে সব। দেশের শান্তি নষ্ট হয়। তার চাইতে বিরাটের বাচ্চার নাম ঠিক করে, রাজ চক্রবর্তীর ছেলের ওজন মেপে, রিয়া চক্রবর্তী কি কঙ্গনার গল্প শুনে, মাঝে মাঝে কয়েকটা এরকম ইঁদুর মেরে শুতে যাওয়া অনেক শান্তির। বলি "জগৎ মিথ্যা আমি সত্য", এ কথা তো মানো?
আমি হতভম্ব হয়ে বসে চেয়ারে। আমার পঞ্চকোশের ব্যাখ্যা ফুলস্পিড তিনহাতের পাখার হাওয়ায় পত পত করে উড়ছে। সামনেই ইঁদুরটা মুড়ি খুঁজছে। মেরে দিলে কেউ জানতে পারবে না। ইঁদুর জানে তার খিদের জন্য, তার যৌনতার সুরক্ষার জন্য কেউ কোনোদিকে নেই। চারদিকে সবাই ঘাড় উঁচু করে পাঁচিলের ওপাশে হাইপ্রোফাইল গেম দেখছে। ইঁদুরটা একা একা ঘরের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে বইখাতা শুঁকে দেখছে। চাইলেই কাটতে পারে। চাইলেই আরো লক্ষ কোটি ইঁদুর এসে আমার সমস্ত গ্রন্থের আভিজাত্য কেটে ছিঁড়ে ছারখার করে দিতে পারে। কিন্তু করে না। ওরা যুগে যুগেই করে না। কেন করে না সে উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু একটা অসহায় জীবনকে তছনছ করে দেওয়ার লালসাকে দুরমুশ করে দেওয়ার ক্ষমতা যে কোনো শাস্ত্র বা ঈশ্বরের নেই, সে প্রমাণ করার জন্য কোনো আদালতের দরকার নেই। তবে সে পাথুরে দেবালয়গুলো ভেঙে পড়ত না অ্যাদ্দিনে! আর দেবালয় জুড়ে এত স্বার্থপরের মানুষের দুর্গন্ধে এতদিনে ঈশ্বর উন্মাদ হয়ে যেত না!