কোনো এক গ্রামে একটা নেড়া ভূত থাকত। সে মৃত্যুর পর থেকেই নেড়া। সেই নিয়ে তার মনের মধ্যে একটু আধটু দুঃখ ছিল না যে তা নয়, তবে কি করবে বলো? কত ডাক্তার-বদ্যি, ওঝা-তান্ত্রিক সব দেখিয়েছে, কিন্তু যদি রত্তিভরও চুল ওঠে গো মাথায়! মাঝেমাঝে জঙ্গলে গিয়ে ঝোপ তুলে নিয়ে মাথায় লাগায়। মাঝে মাঝে ঘাস তুলে মাথায় লাগায়। কিন্তু চুল আর ওঠে না। গ্রামে একটাই সেলুন, হারু নাপিতের। ভূতটা রোজ সকাল হলেই বেঞ্চে গিয়ে বসে থাকে। কত লোকে আসে, চুল কাটিয়ে যায়। আবার একই লোক মাসে, দু’মাসে আবার আসে, চুল কাটিয়ে যায়। ফি মাসে মাসে এত চুল কি করে হয় বাপু তোদের? – এইসব ভাবতে ভাবতে বেজার মুখে বসে থাকে নেড়াভূত। কেউ মরলে শ্মশানে গিয়ে তার চুলটা ধরে দেখে – আহা! পুড়িয়ে দেবে? কিন্তু যেই না একটু ছিঁড়ে মাথায় দিতে গেছে... তা দেবে নাই বা কেন? একটু দইয়ের সাজা দিলে যদি তা থেকে দই হতে পারে, তবে মাথায় একটা চুল গেঁথে দিলে তার থেকে মাথায় অনেক চুল গজাবে না কেন, কচুরিপানার মত? তা যা বলছিলাম, যেই কোনো সদ্য মরা মানুষের চুল মাথায় লাগিয়েছে, অমনি সেই মড়ার ভূত ‘হাঁ হাঁ’ করে ছুটে আসে... বলে, “ওরে রাখ রাখ... চিত্রগুপ্তের ডেটাবেসের সাথে মিলবে না, কোথায় কোন ভাগাড়ে গিয়ে ফেলে দেবে শেষে!”
তা হারু নাপিত জানে তার দোকানে সকাল থেকে নেড়াভূত এসে বসে থাকে বেঞ্চের কোণায়। হারু ওদিকে একটা কুঁজো রেখে দেয়, যাতে কোনো কাস্টমার এসে আবার ওদিকে নেড়াকে চেপে না বসে যায়। আসলে দেখা যায় না তো খালি চোখে ওকে!
সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছে। দোকানে কোনো খদ্দের নেই। নেড়া আর হারু দু’জনে বসে আছে। হারু গান গাইছে একটা গুনগুন করে, আর নেড়া দোকানের কোণে বস্তায় রাখা সারা সপ্তাহের কাটা চুল ঘাঁটছে। মাটিতে ছড়িয়ে নোংরা করবে না নেড়া সে বিশ্বাস হারুর আছে। শুক্রবার করে চুল নিতে আসে শহর থেকে, আজ বুধবার।
হারু বলল, তুমি এই চুলের আশা ছাড়ো এবার দাদা, এমনি ভগবান তোমায় কম তো কিছু দেননি বলো?
নেড়া মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তা ঠিক ভায়া, কিন্তু...
কথাটা শেষ হতে না হতেই একটা বাচ্চা জলে চাপ চাপ ভিজে দোকানে ঢুকেই বলল, তাড়াতাড়ি আমার চুল কাটো, আমার মামা আসবে, এতবড় চুল দেখলেই আর চকোলেট দেবে না আমায়, মামাবাড়িও নিয়ে যাবে না। তুমি কি নখ কাটতে পারো?
হারু একটা কাঠের পাটাতন চেয়ারের হাতলের উপর রেখে তাকে কোলে করে বসিয়ে বলল, তোর মামা মানে ওই সরকারি স্কুলের হেডমাষ্টার না?
ছেলেটা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই উত্তর না দিয়ে হঠাৎ বলল, ওই নেড়া লোকটা কে? ওর কি সব চুল নেড়া করে দিয়েছ হারুকাকা? না ওরও মামা আসবে? ওর মামা কি মিলিটারি?
হারু আর নেড়া দু’জনেই তাজ্জব, ঘাবড়ে গিয়েছে, এদ্দিন তো কেউ দেখতে পায়নি নেড়াকে, তবে এ কি করে দেখল?
ছেলেটা পা দোলাতে দোলাতে বলল, আচ্ছা বলো তো, শ্বেত-বিশ্বামিত্র-স্তম্ভের আগে নাম কি ছিল?
হারু ছেলেটার মাথায় জল স্প্রে করতে করতে বলল, জানি না ভোলু...
ভোলু নেড়ার দিকে তাকিয়ে বলল, নেড়ুকাকু তুমিও জানো না?
নেড়া মাথা নাড়ল, তার এখনও অবাক লাগছে, দেখছে কি করে? হারুকে না হয় সে নিজেই দেখা দিয়েছে বলে সে দেখেছে, কিন্তু ভোলু?
ভোলু বলল, তাজমহল! আচ্ছা বলো তো...
হারু বলল, আর কথা না... মুখে চুল ঢুকে যাবে... চুপ করে বসো... নোড়ো না...
ভোলু হঠাৎ করে হারুর হাতটা সরিয়ে নেড়ার দিকে তাকিয়ে বলল, এই তুমি কি নিত্য’র মত কেমো নাও গো?
হারু বলল, না, ওসব বলতে নেই...
ভোলু বলল, কিন্তু আমি দেখেছি, ও তো আমার থেকে এক ক্লাস উঁচুতে পড়ে, ফাইভে, ওর মাথা পুরো তোমার মত, নেড়া। বাপি বলে ও নাকি আর বাঁচবে না বেশিদিন? তাই হারুকাকু?
কথা বলতে বলতে ভোলুর সারা চোখ জলে ভরে গেল... সে নেড়ার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমিও বাঁচবে না আর? তুমিও মরে যাবে?
নেড়ার এই প্রথম নিজেকে নিয়ে কোনো লজ্জা হল না, বরং অনেকদিন পর কান্না পেল।
ভোলু চুপ করে গেছে। হারুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। সত্যিই ছেলেটার মা’টা বাঁচবে কি করে? নিত্যর দুটো বাড়ির পরেই হারুর বাড়ি। ছেলেটার বাবার সাইকেলের দোকান আছে।
সপ্তাহখানেক পর একদিন অনেক রাতে গ্রামে কান্নার আওয়াজ শুনে নেড়া বুঝতে পারল কি হয়েছে। সে একদিন গিয়ে নিত্যকে দেখে এসেছে। বুঝেছে ওর সময় হয়ে এসেছে। নেড়া নিত্য'র বাড়ির দিকে গেল। অনেক লোক এসে গেছে। নেড়া বাড়ির চারদিকে খুঁজতে খুঁজতে নিত্যকে পেল বাড়ির পিছনের দিকে। মা-কে দেখছে দূর থেকে, তার মা তার শরীরটার উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। নিত্য কাঁদছে না, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আসলে ভিতরে ভিতরে ও ভীষণ কাঁদছে, ওর কাঁপা ঠোঁট দেখে বুঝল নেড়া।
নেড়া গিয়ে নিত্যের হাত ধরল। নিত্য কিছু বলল না। নেড়া তার কানের কাছে গিয়ে বলল, আমার সাথে এদিকে এসো।
নিত্য নেড়ার পিছনে পিছনে গেল। নিত্যের বাড়ির বারান্দায় ঝোলানো খাঁচা। তার মধ্যে টিয়া, সে নিত্যকে দেখেই ডানা ঝাপটিয়ে ডাকতে শুরু করল, এই নিত্য, নিত্য... এই নিত্য, নিত্য...
যেই না পাখিটা ডেকেছে অমনি নিত্যের মায়ের জ্ঞান ফিরে গেছে, তিনি ধড়মড়িয়ে উঠে বললেন, কই লঙ্কা, কই নিত্য?
টিয়াটা অমনি তার সামনের ডানাটা তুলে নিত্যের দিকে ঘুরিয়ে বলল, এই তো নিত্য... এই তো নিত্য...
নেড়া নিত্যকে বলল, তুমি খাঁচাটা খুলে দাও...
নিত্য যেই খাঁচাটা খুলে দিল অমনি টিয়াটা উড়ে গিয়ে নিত্যের মায়ের কাঁধে বসল। বসেই বলতে লাগল ডানা উঁচু করে “ওই তো নিত্য... ওই তো নিত্য...”। গ্রামের সবাই হাঁ করে দুলতে থাকা খোলা খাঁচার দিকে একবার তাকায়, আর একবার পাখির দিকে তাকায়...
নেড়া যেদিন থেকে নিত্যের কেমো নিয়ে নেড়া মাথা দেখেছে, সেদিন থেকে নিজের নেড়ামাথার শোক ভুলেছে। এখন সে নিত্যকে নিয়ে রোজ হারুর সেলুনে যায়। খবরের কাগজ পড়ে তিনজনে মিলে। ভোলুকে নিয়ে নিত্য মাঠে যায়। টিয়াটা উড়ে আসে। টিয়ার সাথে সাথে আসে নিত্য’র মা। ক্রমে গ্রামের আরো নানা পাড়ার ভূতেরা আসতে শুরু করল। গ্রামের মানুষদের সাথে তাদের ফুটবল ম্যাচ হয় প্রতি অমাবস্যার রাতে। রেফারি হয় হারু। সিটি দেয় টিয়া। গ্রামের লোক শুধু গ্রামের মানুষদেরই দেখতে পায়। বাকিদের পায় না, শুধু দেখে ‘হুস্...’ করে বল এই উপরে উঠে গেল, এই ‘ধমাস্...’ করে নীচে এসে পড়ল। এমনকি যখন মেডেল দেওয়া হয়, গ্রামের মোড়ল যিনি উনি তো পরাতে পারেন না, হারুই মোড়ল মশায়ের হাত থেকে মেডেল নিয়ে গলায় ঝুলিয়ে দেয় নেড়ার গলায়। লোকে দেখে একটা চকচকে মেডেল হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। পিছনে পিছনে একটা টিয়া।
তবে সবচাইতে মজা হয় আজকের দিনে, মানে মহালয়ার দিনে। সব পিতৃপুরুষেরা সার দিয়ে গঙ্গার পাড়ে এসে দাঁড়ান। একে একে সবাইকে তর্পণের জল আর একটা করে লাড্ডু দেওয়া হয়। তারপরে সন্ধ্যেবেলা হয় ভুরিভোজ। আহা...! সে দৃশ্য দেখার মত! একদিকে গ্রামের সব লোক সার দিয়ে বসে, অন্যদিকে পিতৃপুরুষেরা। একদিকে লোকে দেখে হাত দিয়ে মেখে মেখে চটকে চটকে লোকে খাচ্ছে, অন্যদিকে শোনে শুধুই ‘সুড়ুৎ সুড়ুৎ’ আওয়াজ, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। তারপর হয় কীর্তনের আসর। শুধু একটাই নিয়ম এখানের কীর্তনের, কেউ রামনাম করতে পারে না। সেটা অবশ্য সাদা কাগজের পোস্টার মারা থাকে সারা গ্রামে। তাই গ্রামে গাওয়া হয়, হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ হরে হরে। হরে ধড়াম, হরে ধড়াম, হরে ধড়াম, হরে হরে।।
এই গান শুনে হারু নাপিত হাই তুলতে তুলতে বলে, রাম হল ধড়াম, কি ইদিকে, কি উদিকে।
[ছবি Suman]