কাঁপা হাতে চশমাটা খুলে মুছে নিলেন। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে চশমাটা আবার পরে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। সপ্তমীর সকাল। ভিড় নেই তেমন মণ্ডপে।
একটা অল্প বয়সী ছেলে এসে বলল, দাদু এই যে চেয়ারটা, বসো। পড়ে যাবে তো। ভোগ খেয়ে যেও।
চেয়ারে বসলেন। ফ্যাকাসে হয়ে আসা নীল জামাটার হাতাটা গুটিয়ে নিলেন। এদিক ওদিক তাকালেন। কাউকে খুঁজছেন যেন। একটা ছেলে এগিয়ে বলল, দাদু কিছু খুঁজছ?
উনি আমতা আমতা করে বলেলেন, ওই গানটা আরেকবার চালাবি…. বাড়ি থেকে শুনছিলাম….
কি গান দাদু? ছেলেটা ভুরু কুঁচকে একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করল... ভাবলো কিরকম অনুরোধ এটা...
বয়স্ক মানুষটার নীচের ঠোঁটটা কেঁপে উঠল। যেন কচু পাতায় হঠাৎ এসে লাগল সজল বাতাসের ছোঁয়া। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, 'এবার আমার উমা এলে, আর উমায় পাঠাবো না... আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ, কারো কথা শুনব না'… যেন নিজেকে বললেন কথাগুলো।
ওঁর গলা বুজে এলো। ছেলেটা হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে। কার গান এটা? কি গান? প্রথম লাইনটা মেসেজে টুকে বলল দেখছি দাদু….
ছেলেটা ক্লাবের সেক্রেটারির কাছে গিয়ে গানটা দেখালো। সেক্রেটারি বলল, কে বলছে?
ছেলেটা বয়স্ক মানুষটাকে দেখিয়ে দিল।
সেক্রেটারি বসে কিছু লেখালেখি করছিল। ছেলেটাকে বলল, রামকুমারের সিডিটাতে পাবি... যা... চালা আমি আসছি… আর শোন... ওঁকে এক গ্লাস জল দে…..
ছেলেটা গিয়ে গান চালালো। রামকুমার গেয়ে উঠলেন,
"এবার আমার উমা এলে
আর উমায় পাঠাবো না৷
বলে বলুক লোকে মন্দ
কারো কথা শুনব না৷৷
যদি এসে মৃত্যুঞ্জয়
উমা নেবার কথা কয়
মায়ে ঝিয়ে করব ঝগড়া
জামাই বলে মানব না৷
এবার আমার উমা এলে
আর উমায় পাঠাবো না৷"
চেয়ারে বসা বয়স্ক মানুষটার কাঁধটা অল্প অল্প কেঁপে উঠল। দুটো শীর্ণ হাতের শিরা ওঠা তালুতে মুখটা ঢেকে ফেললেন।
ক্লাবের ছেলেটা এক গ্লাস জল নিয়ে এসে দাঁড়ালো। দিতে পারল না। অস্বস্তি হচ্ছে। মানুষ কাঁদলে অনেকেই পাশে দাঁড়াতে পারে না। তাও উৎসবের আঙিনায়।
সেক্রেটারি এসে দাঁড়ালেন। ছেলেটার কাছ থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে বয়স্ক মানুষটার কাছে গিয়ে পাশের চেয়ারটায় বসলেন। কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, মেশোমশায় জলটা নিন। খান। শরীর খারাপ করবে তো!
উনি জলের গ্লাসটা কাঁপা হাতে নিয়ে বললেন, ওর মা বেঁচে থাকলে হয় তো মেয়েটাকে পাঠাতো না... না বাবা?..., তবে হয় তো মেয়েটা আমার……
সেক্রেটারি খানিক বসে উঠে এলেন। অনেক কাজ। ছেলেটাকে বললেন, দেখিস উনি যেন খেয়ে যান। ছেলেটা জিজ্ঞাসা করল, ওনার কি হয়েছে?
সেক্রেটারি বললেন, ওঁর একমাত্র মেয়েটাকে শ্বশুরবাড়িতে গায়ে আগুন দিয়ে….
ছেলেটা বলল, জানি জানি... উনি ওর বাবা?... আচ্ছা আমি দেখছি দাদা এদিকটা... তুমি যাও…
ছেলেটা একটা চেয়ার নিয়ে একটু দূরে বসল। গানটা আবার কিউ করে দিয়েছে সেক্রেটারি। চাপা কান্না বেরিয়ে যাওয়া ভালো। রামকুমার গাইছেন…
এবার আমার উমা এলে
আর উমায় পাঠাবো না৷
বলে বলুক লোকে মন্দ
কারো কথা শুনব না৷৷
যদি এসে মৃত্যুঞ্জয়
উমা নেবার কথা কয়
মায়ে ঝিয়ে করব ঝগড়া
জামাই বলে মানব না৷
এবার আমার উমা এলে
আর উমায় পাঠাবো না৷