মাথাটা ঝিমঝিম করছে বলে পরিতোষবাবু তাড়াতাড়ি খাটে এসে শুয়ে পড়লেন। খানিক বাদেই মারা যাবেন, নিশ্চিত তিনি। অনেকের বেলায় শুনেছেন, পায়খানা থেকে বেরিয়েই মাথাটা ঝিমঝিম করে, হাত-পা অবশ হয়ে যায়, জিভ জড়িয়ে আসে, বুকের মধ্যে চাপচাপ অনুভব হয়, তারপর নিজের দিকে তাকাতে তাকাতেই মানুষ মারা যায়। বিশেষ করে পঞ্চাশের উপর বয়েস হলে তো নাকি কথাই নেই। অন্য সময় হলে ডাইজিন-টাইজিন খেয়ে নিলে নাকি সামলে যায়, কিন্তু এই বয়সে আর চান্সই নেই।
কুলকুল করে ঘাম হচ্ছে। পরিতোষবাবু হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে। মাথার উপরে ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে। তার আসন্ন মৃত্যুর সাক্ষী, কিন্তু বড় উদাসীন। জানলার বাইরে পাঁচিলের ওপর একটা কুকুর দাঁড়িয়ে আছে। পাড়ার কুকুর, ঝুনু। সে জানে না তার কিছুটা দূরে একটা মানুষ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। একটু পর বাড়ির সামনে লোকে লোকে ছেয়ে যাবে। কত আত্মীয়-স্বজন সব কাঁদবে। তার সম্বন্ধে ভালো ভালো কথা বলবে। এবেলার চিকেনটা ওবেলা আর খাওয়া হবে না। ফেলা যাবে। মনটা খুঁতখুঁত করে উঠল পরিতোষবাবুর। কেন খাওয়া যাবে না? মানুষের এই নিরামিষ খাওয়ার বাতিকটাকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না পরিতোষবাবু। আরে ভাই তোর গোটা শরীরটাই যখন আমিষে গড়া, তুই মরতে ওসব শাক-পাতা খেতে যাবি কেন খালি খালি? হাতি-গরু খায় সে তারা নিজেদের ইনস্টিংক্টের বাইরে যেতে পারে না বলে। প্রকৃতি যা দিয়েছে তাই তাদের মাথা পেতে নিতে হবে। তুই মানুষ, তুই পোড়া ঝলসানো খাবার খেলি, রান্না করতে শিখলি, সেই দাবানলের আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া থেকে শুরু করে মাইক্রোওভেন অবধি এলি; গুহা থেকে এত বড় বড় মাল্টিপ্লেক্স বানালি; চামড়ার ছাল থেকে পিটার ইংল্যাণ্ড, ভিমল অবধি চলে এলি --- তাও এখনও প্রকৃতির দোহাই দিবি? মায় আদিম প্রবৃত্তিটাকে পর্যন্ত রবারের ঠোঙায় কি ভায়াগ্রা খেয়ে নায়াগ্রা অবধি পৌঁছে গেলি, কিন্তু ধম্ম আর খাওয়া-দাওয়াতেই তোদের যত প্রকৃতি আর ভগবানের দোহাই লাগে? জঙ্গল কেটে সাফ করে দিয়ে, দূষণে দূষণে ভরপুর করে সব প্রকৃতির দোহাই দিচ্ছে। তা এতই যদি প্রকৃতিগামী হবি তবে গরমে পাখা, এসি না চালিয়ে গাছতলায় গিয়ে শুয়ে পড় না রে বাপু!
এতগুলো কথা একসাথে ভেবে পরিতোষবাবু পালসটা চেক করলেন একবার, ১১৫। যথেষ্ট জোরে। মানে এখনই একটা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হবে। জলের বোতলটা থেকে এক ঢোক জল খেলেন। একবার ভাবলেন গিন্নীকে ডাকেন, কিন্তু কিছু একটা না হলে যদি শুধুমুধু তার কাঁচা ঘুম ভাঙানো হয় তবে তিনি বাড়ি মাথায় করবেন। থাক তার চাইতে। পরিতোষবাবু চোখ বন্ধ করে কিছু ভালো কথা ভাবতে চেষ্টা করছেন। যেমন গীতার কথা, বা কোনো শাস্ত্রের শ্লোক। এই সময়ে মনে পড়াটা উচিৎ। কৃষ্ণ বা রামনাম করতে চাইছেন, কিন্তু ওইসব নাম ভাবতে গেলেই সুইচ টেপা ভোটের যন্ত্রটা মনে পড়ে যাচ্ছে। কি একটা যেন মনে পড়ছে......
হিজিবিজ্বিজ্ বলল, 'হ্যাঁ, সজারু চিনি, কুমির চিনি, সব চিনি। সজারু গর্তে থাকে, তার গায়ে লম্বা লম্বা কাঁটা, আর কুমিরের গায়ে চাকা-চাকা ঢিপির মতো, তারা ছাগল-টাগল ধরে খায়।' বলতেই ব্যাকরণ শিং ব্যা ব্যা করে ভয়ানক কেঁদে উঠল।
আমি বললাম, 'আবার কি হল?'
ছাগল বলল, 'আমার সেজোমামার আধখানা কুমিরে খেয়েছিল, তাই বাকি আধখানা মরে গেল।'
আমি বললাম, 'গেল তো গেল, আপদ গেল। তুমি এখন চুপ কর।'
কিন্তু এতো শাস্ত্রের কথা না! এ তো ‘হ য ব র ল’, সুকুমার রায়ের! এই সময়েও হাসি পেল। “ন্যাড়ার তিনমাস জেল আর সাতদিনের ফাঁসি”। এই কথাটা মনে পড়তেই মনে হল পেটের মধ্যে কে যেন একটা সুড়সুড়ি দিয়ে গেল। ঘামতে ঘামতে হাসলেন। আবার পালস দেখলেন, ১১৯। বেড়েছে। মানে সে কাছেই!
কলিংবেল বাজল। মৃত্যুশয্যা থেকে উঠে পরিতোষবাবু দরজাটা খুলতে গেলেন। আর কে যাবে? বললাম না গিন্নি ঘুমাচ্ছেন।
একটা ছোকরা। হেসে বলল, আপনি পরিতোষবাবু তো? মানে পরিতোষ মল্লিক?
পরিতোষবাবু বললেন, হ্যাঁ ভাই, কেন?
আমি জল দিতে এসেছি?
কোথায়?
ইনভার্টারে স্যার... আপনি কিনেছেন যে কোম্পানি থেকে সেই কোম্পানির এটা স্কিম, কাস্টমার ওয়েলফেয়ার সার্ভিস। আমরা মাঝেমাঝেই এসে জল দিয়ে যাব।
কিন্তু জল যে শুকিয়েছে কি করে জানলে?
জানা যায় স্যার, যেমন আপনি এক গ্লাস জল খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আপনার একটা মূত্রাবেগ আসবে... সেটা যেমন আপনি জানেন, এও তেমন...
এসো...
পরিতোষবাবু ছেলেটাকে চেয়ারে বসতে বলে নিজে খাটে শুলেন। তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমার অন্তিম সময় এসে গিয়েছে। তুমি কি হরিনাম করতে পারো? যদি পারো তবে করো, এই সময়ে মানুষ ঈশ্বরের নাম শুনে মরে, এটা একটা ট্রাডিশান, তুমি গাও, আমি ধীরে ধীরে মরি।
ছেলেটা কিছুটা মাথা চুলকে বলল, স্যার আগে জলটা দিয়ে আসি, নইলে আপনি মারা গেলে অনেক হাঙ্গামা হবে। অনেক দিন ধরে অনেক লোক থাকবে, আসবে যাবে। জল দেওয়ার সুযোগ পাব না। মাঝখান থেকে এত দামী মেশিনটা স্যার বসে যাবে। সেটা কি ভালো হবে বলুন? আপনি পনেরো মিনিট হোল্ডে থাকুন স্যার, আমি জলটা দিয়ে আসি। এসেই আপনাকে হরিনাম শোনাচ্ছি। আমার ঠাকুমা মারা যাওয়ার সময়ও আমি গেয়েছিলাম। ঠাকুমা জাস্ট সাত থেকে আট মিনিট সময় নিয়েছিল স্যার। চোখের সামনে দেখলাম। পাওয়ার বটন, পাওয়ার অফ্, শাট ডাউন। ব্যস, শেষ।
পরিতোষবাবু উঠতে যাচ্ছিলেন। ছেলেটা থামিয়ে দিয়ে বলল, আমি জানি কোথায় আছে স্যার। আমিই লাগাতে এসেছিলাম। আপনার বউয়ের হাতে বানানো জিলিপি খেয়েছিলাম। কি মজা স্যার, প্যাঁচে প্যাঁচে রস।
ছেলেটা ঠিক দিকেই গেল, সাথে একটা জলের জার। কত বয়েস হবে? বাইশ-তেইশ হবে। রোগা, ফর্সা, চোখদুটো কি দুষ্টুমিতে ভরা? পরিতোষবাবুর চোখের কোণাটা চিকচিক করে উঠল। ছেলে কি তার নিজের নেই। তারা কি ঠিকানা জানে না, না তার ফোন নাম্বারটা জানে না। তবে? মারা যাওয়াই ভালো। কুসুম ওর বোনের কাছে চলে যাবে। বিয়ে থা করেনি, একা থাকে, অধ্যাপনা করে। শ্যালিকাকে দেখে কিছুটা হিংসাই হয় পরিতোষের।
ছেলেটা এসে বসল চেয়ারে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পরিতোষবাবু উঠলেন। ফ্রিজ খুললেন, দুটো কড়াপাকের সন্দেশ আর একগ্লাস কোল্ড্রিংক্স এনে ছেলেটার পাশের টেবিলে রাখলেন।
ছেলেটা কিছু একটা বলতে যাবে, হঠাৎ ঘরে কুসুম ঢুকলেন। চোখদুটো লাল। মানে কাঁচা ঘুম ভেঙেছে। ঢুকেই ছেলেটাকে দেখে বললেন, ও বাপি... কখন এলি বাবা... কাকু দরজা খুলে দিল? কে এনে দিল ওগুলো? কাকু?
পরিতোষবাবুর ভয়ানক রাগ হচ্ছে নিজের উপর, কুসুমের উপর, আর এই বাপি না হাপি – তার উপর। নিজের দুর্বলতা বাইরে দেখাতে একদম পছন্দ করেন না তিনি। সংসার একটা গিভ-এণ্ড-টেক পলিসিতে চলে। প্রয়োজনবাদ। তোমার আমাকে প্রয়োজন, আমার তোমাকে, ব্যস তৈরি হল সমাজ। সমাজের ছোটো ইউনিট সংসার; মাইক্রো ইউনিট।
কুসুম গল্প করছেন। কিসের খিদে কুসুমের সেকি জানে না পরিতোষ, কি হ্যাংলামিরে বাবা! আরে আমাদেরটা আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে, ব্যস। মেনে নিতে শিখতে হয়। রবীন্দ্রনাথকে কত কিছু মেনে নিতে হয়নি?
ছেলেটা বলল, উঠি কাকু...
কেন উঠবে এখন? আরো কাজ আছে তোমার? বসো, আমি আর কাকিমা একটু গল্প করি তোমার সাথে... চা খেয়ে যেও একেবারে বিকেলে...
ছেলেটা বসল না। আরো অনেক বাড়ি যাওয়ার আছে। কুসুম শুতে গেলেন না। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ওকে চলে যেতে দেখলেন। তারপর খাটের এক কোণায় শুয়ে বললেন, আমরা অস্ট্রেলিয়া যেতে পারি না?
যেতে পারি, ফিরবার টাকা আর থাকবে না... ওরা কি আমাদের বাকি জীবন রাখবে?
কুসুম জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুলেন। পরিতোষ উঠে কাঁচের পাল্লা খুলে একটা বই নিয়ে এলেন। পড়তে শুরু করলেন---
বেজায় গরম। গাছতলায় দিব্যি ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু ঘেমে অস্থির। ঘাসের উপর রুমালটা ছিল; ঘাম মুছবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি অমনি রুমালটা বলল, 'ম্যাও!' কি আপদ ! রুমালটা ম্যাও করে কেন?
চেয়ে দেখি রুমাল তো আর রুমাল নেই, দিব্যি মোটা-সোটা লাল টক্টকে একটা বেড়াল গোঁফ ফুলিয়ে প্যাট্ প্যাট্ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, 'কি মুশকিল! ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল।' অমনি বেড়ালটা বলে উঠল, 'মুশকিল আবার কি? ছিল একটা ডিম, হয়ে গেল দিব্যি একটা প্যাঁকপেঁকে হাঁস। এ তো হামেশাই হচ্ছে।'
কুসুম হাসতে হাসতে চোখের কোণা মুছতে মুছতে বললেন, হ্যাঁ, এ তো হামেশাই হচ্ছে। পরিতোষবাবুর চোখের কোণায় চিকচিকে জল।
(ছবি – Suman)