"মা নেই", ব্যস, এই দুটোই শব্দ। তিনটে অক্ষর। কি অসীম শূন্যতা। প্রায় ন বছর, এই দুটো শব্দ সব কিছু বদলে বদলে দিচ্ছে। রোজ অল্প অল্প করে সব কিছু বদলে দিচ্ছে। দিনের আলোর রঙ, রাতের আকাশের স্নিগ্ধতা, ভাতের গন্ধের তৃপ্তি, ধুপের গন্ধের আরাম, রাতের বিছানায় মাথার বালিশের শান্তি - সব বদলে দিয়েছে। হাসির মুক্তোগুলো মেকি। কান্নারা অর্থহীন। বিষণ্ণতা ক্লান্তিহীন, শ্রাবণের আকাশের মত ভার। বর্ষার মেঘের রঙ, শীতের কুয়াশার আড়াল, শরতের শাড়ির আঁচলের মত আকাশ...সব একটা শব্দে এসে বিঁধে - মা নেই। তাই কিচ্ছু নেই যেন। সব আছে, কিন্তু আমায় সেভাবে আর স্পর্শ করে কই কিছু? আমার গায়ে যেন মোমের আস্তরণ। স্পর্শ আছে, অনুভব নেই।
আজকাল আর শাড়িগুলোর দিকে তাকালে মন খারাপ হয় না। শাঁখাটার দিকে তাকালে মায়ের হাতটা মনে পড়েও বুকে জ্বালা ধরায় না। শালের রঙটায় কান্না জাগায় না। আজকাল সব কিছু শুধু এক শূন্যতায় মিশে যায়।
প্রতিদিন সকাল থেকে রাত কতরকম চেষ্টা করি। উদ্দেশ্য একটাই, নিজের সঙ্গে নিজের একটা মা ছাড়া সম্পর্ক বানিয়ে ফেলা। হয় কই? হয় না। কত লেখা, পড়া, বাড়ির নিত্য হাজারটা কাজ, কর্তব্যের সারি - অবশেষে সব শেষ হয়ে যায়। কিন্তু শেষ রাতে ওই শব্দদুটো আবার ফিরে এসে বুকের উপর পা ছড়িয়ে বসে। মা, ঠাকুমা, দিদার কাছে শুনেছিলাম, অনেকবার শুনেছিলাম, আমি নাকি ছোটোবেলায় মায়ের বুকের উপর উপুড় হয়ে না শুলে ঘুমাতাম না। মা বলতেন, "আমি নিঃশ্বাসটাও চেপে রাখতাম, যদি তুই উঠে পড়িস সেই ভয়ে, তুই ব্যাটা হাত পা ছড়িয়ে কি আনন্দে আমার বুকের উপর শুয়ে ঘুমাতিস"।
এখন আমার পালা। আমার বুকের উপর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে একটাই কথা, "মা নেই"। আমিও শ্বাস চেপে শুয়ে থাকি। আমার চারদিকে এমন অদ্ভুত শূন্যতা, যাকে কোনো "আছে" দিয়েই পূরণ করি সে জো নেই। যে মাকে ঈশ্বরকে চেনার আগে চিনেছি, ঈশ্বরেরই বা সাধ্য কি তার আগে এসে দাঁড়ায়। বরং এ শূন্যতাই থাকুক, যতদিন আমি নিজে না শূন্যে মিশে যাই। এ তো দুঃখ শোক নয়, এতো কর্তব্য। নির্মম কঠিন কর্তব্য। আসলে আমি তো বড়সড় কোনো মানুষ নই, যে আমার জীবনে কোনো মহৎ সমস্যার সমাধান করা লাগে। আমার এ ছোট্টো জীবনের পরিখায় এ বড় গভীর ভার, একে বহন করার কর্তব্যই বিধাতা এক আমার উপর দিয়েছেন, একে বহন করা লাগে, সর্বশক্তি দিয়ে।