দুটো মৃত্যু। একজন সম্রাট, আরেকজন (The General in His Labyrinth) এক অখ্যাত যুবক (Chronicle of a Death Foretold)। প্রথমটা স্বাভাবিক মৃত্যু, দ্বিতীয়টা হত্যা। একটা উপন্যাস, আরেকটা প্রায় উপন্যাস বা বড় গল্প। প্রথমটার রচনাকাল ১৯৮৯, আর দ্বিতীয়টার রচনাকাল ১৯৮১। একটার পটভূমিকা রাজনীতি, আরেকটার পটভূমিকা সমাজ। খানিক গল্পটা বলে নিই আগে।
|| The General in His Labyrinth ||
সিমোন বলিভার। তার জীবনের শেষ সাত মাসের বর্ণনা। সিমোন বলিভার কে ছিলেন, ইতিহাসে তাঁর অবদান কি, কেন তাঁকে অনেকে নেপোলিয়ানের সমকক্ষ বলে মনে করেন, কোন কোন দেশ কিভাবে স্বাধীন করেছিলেন, কিভাবে নিজের বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, শেষে কিভাবে নিজের দেশ ছেড়ে চলে যান এবং যাত্রাপথে মারা যান – এসবের জন্য উইকিপিডিয়া রইল। আর মেলা ইতিহাসবিদেরা তো রইলেনই। আমার ইতিহাসের জ্ঞান সাধারণের চাইতেও দুর্বল। তবু বইটা কেন পড়লাম? একটাই কারণ – গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ।
|| Chronicle of a Death Foretold ||
আশ্চর্য গল্প। অনেকে বলেন, এই ঘটনাটার মার্কেজ নিজে সাক্ষী ছিলেন। এক দেশে এক ধনী যুবক আসে। সে দেশের এক মেয়েকে তার পছন্দ হয়। বিরাট জাঁকজমক করে বিয়ে করে সেই মেয়েকে। এমন আড়ম্বর নাকি সে দেশে আগে কারোর বিয়েতে হয়নি। কিন্তু বিয়ের রাতেই সে যুবক টের পায় তার স্ত্রী কুমারী নয়। তাকে সাথে সাথে সেই বিয়ের রাতেই তার বাপের বাড়ি রেখে আসে। সেই মেয়ের দুই ভাই তার বোনকে জিজ্ঞাসা করে, কে তার এই সর্বনাশ করল? বোন যার নাম করে সে-ই গল্পের নায়ক, যাকে ঘিরে গল্পটা। দুই ভাই তাড়াতাড়ি ছুরি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ধার দেয়, সরাইখানায় মদ খায়, সারা শহর ঘুরে বেড়ায় আর বলে বেড়ায় যে তারা আমাদের গল্পের নায়ক যে তাকে খুন করবে। কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। ওদের মত ভালো দুই ছেলে কখনও খুন করতে পারে? তবু অবশেষে পুরো শহর ভোরের মধ্যেই জেনে যায় যে, তারা ছেলেটাকে খুন করবে। অনেকেই যে যার মত চেষ্টা করে খুনটাকে আটকাতে – কিন্তু অবশেষে খুন হয়।
|| আমার অনুভব ||
শেষ গল্পটা দিয়েই শুরু করি। শুরু থেকেই বুঝে গেলাম কে খুন হবে, কেন হবে, কারা করবে? তবে আর পড়ার কি থাকে? থাকে। সেটাই মার্কেজ দেখান। প্রতিটা ঘটনায় যা সামনে আসে তা ঘটনার চাইতে বড় কিছু একটা – মানুষ। ভালো-মন্দ, যুক্তি-অন্ধ আবেগ, স্বার্থপর-নিঃস্বার্থ মানুষ। এরা কেউ আলাদা আলাদা চরিত্র নয় – একই চরিত্রের নানা রঙ। মার্কেজের যে অনেক তুলি। মোটা দাগের, সরু দাগের। মার্কেজ একটা মোটা কালো দাগ টানতে টানতে হঠাৎ করে একটা লাল রঙের ছোঁয়া দিয়ে দেন। সে লালটা বুকে এসে বেঁধে। যেমন ছেলেটাকে মারার সময় এক ভাইয়ের হাত কাঁপছিল। সে মনে মনে বুঝতে পারছিল না যে তারা ঠিক করছে না ভুল করছে। কিন্তু যে কোনো উন্মাদনার মূল শক্তিই তো প্রমত্ত হয়ে ওঠা, বিচার টিকবে কেন? আরেক ভাই তার হাত ধরে তার বিবেকের নড়ে ওঠাটার দিল গলা টিপে। ব্যস কাজ সোজা হয়ে গেল। সরাইখানার যে মালকিন, সে তো ভিখারিকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিল, সাবধানে থাকতে বলেছিল। সে তো এটাও চেয়েছিল ঘাতক আর হত্যাকারী দু'জনেই যেন নিরাপদে থাকে, পাপে লিপ্ত না হয়। বয়েস অল্প যে। কিন্তু একটা সমাজ যখন অভিভাবকহীন হয় তখন যা হয় তাই হল। বিবেকের কথা ফুটে ওঠে, কিন্তু মানুষ তো শুধু হৃদয় না, পশুও তো বটে। তাই বীজগুলো অঙ্কুরিত হতে না পেরে ধর্ম আর নানা কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসের বন্ধ্যা মাটিতে শুকিয়ে মরে। সে শহরের তীরে বিশপের স্টীমার এসে ভেড়ে নির্দিষ্ট দিনে। তিনি নীচে নামেন না। সারা শহর ছুটে যায় উপঢৌকন নিয়ে সে স্টীমারের দিকে। কত লোকে আশীর্বাদ ভিক্ষার জন্যেও ছোটে কাঙালের মত। পায় না, অপেক্ষায় থাকে পরেরবারের। সেই খুনের পটভূমিকা যেদিন তৈরি হচ্ছিল সেদিনও তো বিশপের আসার দিন ছিল, এসেছিলও তো, ঈশ্বরের বন্ধ্যা করুণা বাহকের ছদ্মবেশে। এ তো সেদিনের স্পেনের গল্প না। আজকের হাওড়ার বুকেও তো ভ্যাটিকান সিটি গড়ে উঠেছে, দেখেননি? কয়েক কোটি টাকা খরচ করে, বেদটেদ পড়ে শৌচাগার উদ্বোধন হল যে গো সেখানে? সেই শহরের বাকি অংশে কি অসামান্য ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত কি জানি না আমরা?
আসলে মার্কেজ জানেন মানুষের গল্প মানুষের ভাষাতেই বলতে হয়। মত, আদর্শ, নিয়মনীতি ইত্যাদি যে মানুষ বানায়, সেই মানুষের কোনো দেশ-কাল হয় না। সে যে আদিম অকৃত্রিম মানুষ – এই একটাই পরিচয় তার।
তাই সেই দোর্দণ্ড প্রতাপ সম্রাটের অন্তিম করুন দিনগুলোতে সাক্ষী হিসাবে পাঠককে যখন সিমোনের সাথে নির্বাসনে পাঠায় মার্কেজ – সেও ধীরে ধীরে একটা মানুষের গল্প হয়ে ওঠে। রাজার গল্প, অহং-এর নিঃশঙ্ক ঔদ্ধত্য, নিষ্ঠুরতা, কৌশল, বিশ্বাসঘাতকতা, ষড়যন্ত্র সবই তো আছে। আসলে যে মানুষটা একটা দেশের সাথে এমনভাবে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিল আজীবন সে তো নিজেই সে দেশটা হয়ে যায় না? একছত্র অধিপতি থাকতে থাকতে, দেশটাকে ভালোবাসতে বাসতে একটা নির্বিচার অধিকারবোধ জন্মে যায় না দেশটার উপর? তখন মনে হয় সেই দেশটার মাটি, নদী যেন তার নিজের রক্ত আর মাংসে গড়া। সবটাই যেন সে নিজে। একটা দেশের অস্তিত্ব তার নিজের অস্তিত্বের সাথে এক হয়ে যায়। এমনই তো হয়, না? হয় হয়। ভালোবাসার একটা স্বভাব হল সে ভাবে সেই ভালোবাসার দামে সে ভালোবাসার বস্তুটার উপর একছত্র অধিকার পেয়েছে। সে দেশই বলো আর মানুষই বলো। এর বিপরীত কিছু হলে সে অভিমান করে বলে, কেন আমি কি ভালোবাসিনি? তাতে কি খাদ ছিল? স্বার্থ ছিল? থাকে না, খাদ বা স্বার্থ দুই-ই থাকে না। কিন্তু তবু যে অধিকার রাখতে নেই। সময় হলে নিজেকে সরিয়ে নিতে হয়। তাতে আর কিছু না হোক ভালোবাসার মানটা অন্তত থাকে, সাথে নিজের মান। নইলে সিমোনের মত অভিমানে বলে উঠতে হয় – I don’t exist. কতবড় কথা? কিন্তু এতো অভিমানের কথা, আত্মবোধের কথা তো নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন সন্ন্যাসীও তো আছে যে চরম আত্মদান করেও শেষে সে আত্মদানের মূল্য চাইতে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ফেরেনি। তবু সবার শেষে মানুষ মানুষই। ভালোবাসার এক টুকরো সম্পদে শেষ নিঃশ্বাস হারানোর পুঁজি খোঁজা একটা অসহায়, নিঃসম্বল মানুষ। সিমোনও তাই। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক জটিলতা অনেক বেশি।