দুটো ঘটনা খুব স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করছে আমাদের ভাবনাচিন্তা কোনদিকে যাচ্ছে।
প্রথম ঘটনা। সদগুরুর মস্তিষ্কে সদ্য একটা জটিল অস্ত্রোপচার হল। মাথার রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছিল, এবং যে অবস্থাটা প্রাণঘাতী ছিল। চিকিৎকরাই বলেছেন।
সেই সংক্রান্ত দুটো পোস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে নিউজ চ্যানেলগুলোতে।
প্রথম ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সদগুরু মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা অবস্থায়, হাস্পাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে মজা করে ভিডিওতে বলছেন, “ডাক্তারেরা আমার মাথা খুলে সেটা শূন্য দেখে আবার জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে হতাশ হয়ে।”
অবশ্যই তিনি মজা করতে পারেন। কিন্তু বিষয়টা হল এটা কি সত্যিই নিছক একটা মজা? নাকি অন্য কিছু? কেন অপারেশানের পরে প্রথম ভিডিওটাতেই উনি ডাক্তার, নার্স ও আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি নিজের কৃতজ্ঞতা জানানোর দরকার মনে করলেন না? কেন প্রথমেই শুধু মজা দিয়ে ওঁর অসুস্থতা আর চিকিৎসাটাকে উপস্থাপনা করে লঘু করার চেষ্টা করলেন? এরপর অবশ্যই উনি নিশ্চয়ই অফিসিয়ালি কৃতজ্ঞতা ওঁর সোশ্যালমিডিয়া হ্যাণ্ডেলে দেবেন। কিন্তু সেটা হবে পরে। আগে এই ভিডিওটা।
মনে হতে পারে একটা সাধারণ কথাকে আমি এমন বক্র দৃষ্টিতে কেন দেখছি?
আসলে যতটা সরল মনে হচ্ছে ব্যাপারটা ততটা সরল না তো। যখনই কোনো মানুষ নিজেকে এনলাইটেন্ড বলে থাকেন, যিনি বলেন মানুষকে ভালো থাকতে হলে ওঁর দ্বারা প্রচারিত “ইনার ইঞ্জিনিয়ারিং” কোর্সের ভিতর দিয়েই যেতে হবে, সেখানে বোঝাই যাচ্ছে একটা সুপ্রিমেসির খেলা আছে। সত্যকে সার্বজনীন, যুক্তিগম্য না করে যখন মিস্টিক দেখানো হয়, প্রকাশ্যে সাপের বিষ হজম করে ফেলার মত ঘটনা দেখানো হয়, তখন বুঝে নিতেই হয় যে সাধারণের নাগালের মধ্যে থাকা যে কোনো বিদ্যা বা শিক্ষাকে একটু কম গুরুত্বপূর্ণভাবে দেখানোর একটা প্রবৃত্তি থাকবেই।
আরো মজার ভিডিও হল ডাক্তারের বিবৃতিটা, যেটাও সদগুরুর প্রতিষ্ঠানের সোশ্যালমিডিয়া থেকে প্রচারিত হচ্ছে, তিনি একটা কাগজ দেখে বলছেন। বক্তব্য শুনে বোঝাই যাচ্ছে কতটা স্ক্রিপ্টেড ও সুপরিকল্পিতভাবে বক্তব্যটা সাজানো। যাতে সদগুরুর সব মুশকিলআসান, মিস্টিক ইমেজে কোনো ছাপ না পড়ে। সেখানে দুটি স্তুতির জায়গা বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। এবং সেই স্তুতি গাইছেন চিকিৎসক স্বয়ং। এক, উনি অত্যন্ত ব্যথা সহ্য করেও, শুধুমাত্র নিজের মিটিং ইত্যাদি চালিয়ে যাবেন বলে চিকিৎসা করাতে চাইছিলেন না। এমনই কমিটেড উনি। আর দ্বিতীয় স্তুতি হল, অবাক করা গতিতে উনি সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন।
ভয়টা এইখানেই। এই স্তুতিবাদে। আমাদের প্রাচ্যের মাটিতে কণায় কণায় এই স্তুতিবাদ। আমরা স্তুতিকে, স্তুতিকারককে ও যার উদ্দেশ্যে স্তুতি তাকে এক অবিচ্ছেদ্য, ত্রুটিহীন, পূর্ণতার রূপ হিসাবে দেখি। ভয়টা ওখানেই। আমি বলছি না মানুষ শ্রদ্ধাহীন হবে। শ্রদ্ধা অবশ্যই থাকবে। কিন্তু তার ভিত্তি কী? মূল্যবোধ, না অযৌক্তিক বিস্ময়বোধ? দ্বিতীয়টা হলেই বিপদ। কারণ আমি নিজেই তখন নিজের অজান্তে যুক্তিবুদ্ধির বাইরে গিয়ে পড়েছি। আমার বিপদ আমি নিজেই ডেকে আনব। না, আমার জীবিকায় কোনো অসুবিধা হবে না। কারণ সেটা চালাতে গেলে যে প্যাটার্নটা লাগে সেটা আমি শিখে গেছি। কিন্তু আমার মূল্যবোধ এখন থেকে এক অন্ধ শ্রদ্ধার দ্বারা চালিত হবে। মানুষ হিসাবে আমি আরো কনফিউজড বাঁচব শুধু না, বুদ্ধিমত্তার দৈন্যে ভুগব। এটা ভাবনার।
আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন, আমিও শুভকামনা জানাই। অন্তর থেকেই জানাই। কিন্তু অনুগ্রহ করে এমনভাবে একটা সত্যকে “বিলিটিল” করার চেষ্টাটা করবেন না। ওটা সরলতা না। সরলতার মুখোশ। ভীষণ ক্ষতিকর ওটা।
দ্বিতীয় ঘটনা। জোম্যাটো। হঠাৎ করে তাদের মনে হল নিরামিষ আর আমিষের জন্য দুটো আলাদা ইউনিফর্ম থাকা উচিত। আমিষের জন্য লাল। আর নিরামিষের জন্য সবুজ। এমনকি তাদের খাবার নিয়ে যাওয়ার বাক্সগুলোর রঙও বদলে দেওয়া হল।
এই বদলে অনেকে খুশি হল। অনেকে অখুশি। অখুশি হওয়ার কারণ হল যে যারা আমিষ অর্ডার দিচ্ছে তারা তো প্রকাশ্যে এসে যাচ্ছে না! বাড়িওয়ালা ওই লাল জামা দেখেই তো জেনে যাচ্ছে যে এরা আমিষ অর্ডার দিচ্ছে। প্রাইভেসি বলে কিছু থাকছে না তো! সেটা কী হতে দেওয়া যায়? তবে তো লোকে অন্য কোম্পানি থেকে খাবার অর্ডার করবে। জোম্যাটোর ক্ষতি হবে না তাতে? অগত্যা আবার সেই পুরোনো লাল জামা চলে এলো। আমিষ নিরামিষের পার্থক্য আপাতভাবে বাইরে থেকে সরিয়ে দেওয়া হল।
এখন দেখুন, এই আমিষ বনাম নিরামিষের লড়াই বিশ্বজুড়ে। কিন্তু সমস্যা হল পাশ্চাত্যে আমিষ আর নিরামিষের লড়াইটা রুচি, নীতি ইত্যাদি নিয়ে। পবিত্র অপবিত্রতা নিয়ে নয় কিন্তু।
মজার কথা হল রুচির পার্থক্য নিয়ে একটা যুদ্ধ করা যায় না। পোশাকে, খাবারে, গানে, গৃহসজ্জায় ইত্যাদিতে অতি অর্থোডক্স পরিবারে, কি সমাজেও বৈচিত্র্যের উদাহরণ আছে। কিন্তু সমস্যা হল পবিত্রতা আর অপবিত্রতার মাপকাঠিতে। আসলে এর তো কোনো মাপকাঠিই নেই। স্বাস্থ্যবিধি বা হাইজিন আর পবিত্রতা তো এক জিনিস নয়। হাইজিন শিখতে হয়। তা প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্তু পবিত্রতা শিখতে হয় না। মানতে হয়। তা নতি-সাপেক্ষ। অনেকেই এই পবিত্রতার ফাঁদে পড়ে যে কিভাবে অপরিষ্কার জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন সে চারদিকে চোখকান খোলা রাখলেই দেখতে পাওয়া যায়।
আমরা যাকে ধর্ম নিয়ে লড়াই বলি, আসলে সেটা আমি পবিত্র আর তুমি অপবিত্রের লড়াই। আমাদের দেশে বর্তমানে এই লড়াইটাই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে চলছে। ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমার পবিত্রতার কিছু প্যারামিটার আছে। সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ একটাই কারণ সে আমার বাপ-ঠাকুর্দা মেনে এসেছে। যত পুরোনো তত পবিত্র। ধর্মকে কেন্দ্র করে যত যত প্রাণ হানাহানি হয়েছে সব এই নিজের পবিত্রতাকে অন্যের উপর কায়েম করার জন্য।
জোম্যাটো এই মার্কেটটাই ধরতে চেয়েছিল। কিন্তু যখন নিজেদেরই প্ল্যান নিজেদের ব্যাকফায়ার করে তখন উল্টো সুর গাইতে শুরু করল।
সদগুরুর মজারু ভিডিও আর জোম্যাটোর বোধিলাভ - দুটোই আপাত দৃষ্টিতে খুব সামান্য ঘটনা। কিন্তু একটু ভালো করে তাকালে ততটা নিরীহ নয় যতটা মনে হচ্ছে। আমাদের সমাজে আমরা একজন গুরুঠাকুর খুঁজতে চাইছি প্রাণপণে। আমাদের পবিত্রতা, আমাদের সংস্কার, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের প্রাচীনত্ব - সব কিছুর একটা মায়াজাল তৈরি করে গোটা বিশ্বকে তুচ্ছ করে আমরা আমাদের বড় করতে চাইছি। এ ভীষণ ভালো কিছু যে হচ্ছে তা তো নয়। জগত যখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। মন্দ কি ভালো ঠাহর করতে পারছে না। তখনই আমরা এক ইলিউসিভ ইন্টালিজেন্সকে জাগিয়ে তুলতে চাইছি। কথায় আছে না, একা রামে রক্ষে নেই সুগ্রীব তার দোসর। একা এ-আই এর গুঁতোয় হিমশিম গোটা দুনিয়া, সঙ্গে আমাদের এই আই-আই যদি যোগ দেয়, বাঁচব কি আমরা?
আমাদের সত্য অর্থে মূল্যবোধ বাড়ুক। প্রাণ-যুক্তি-বুদ্ধি সবল হোক। পায়ের তলায় মাটি আসুক।
(অনুগ্রহ করে সদগুরুকে নিয়ে বা কোনো ধর্মকে নিয়ে কোনো অসম্মানজনক মন্তব্য করবেন না।)