এমন স্বল্প পরিসরে এতটা গভীরে লেখা যায় এ ভাবলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়।
বইটা প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম ২০০২ সালে। লেখক লিখছেন "এই ক্ষুদ্রগ্রন্থ প্রচুর পরিশ্রমের ফল। আশা করি সহৃদয় পাঠকরা বইটি পড়ে খুশি হবেন। নইলে এটাকে আমার বৃথা পণ্ডশ্রমই মনে করব"।
বইটার উপর নজর পড়ল মায়া মজুমদারের লেখা 'নদীয়া জেলার লোকসঙ্গীতে বৈষ্ণবপ্রভাব' বইটা পড়তে গিয়ে। বাংলায় বৌদ্ধ সম্প্রদায় নিয়ে কিঞ্চিৎ বলেছেন সেখানে। আমি খুঁজতে শুরু করলাম কোনো বই যা এই নিয়ে কিছু লেখা থাকবে। খুঁজতে খুঁজতে পেলাম এই বইটা। লেখক সাধনকমল চৌধুরীর লেখা আগে পড়েছি, ভীষণ সুখপাঠ্য লেগেছে আমার ওঁর লেখা, এই বইটাও তাই লাগল। এত অল্প পরিসরে বৌদ্ধধর্ম, পাল-সেন বংশের প্রভাব, তন্ত্রের উদ্ভব, পদবীর ইতিহাস, সনাতন ধর্ম, ইসলাম ধর্মের প্রভাব বৌদ্ধদের উপর। আরো নানাদিক নিয়ে চুম্বকে চুম্বকে লিখে গেছেন। চট্টগ্রাম, মহাত্মা ও আম্বেদকরকে দিয়ে শেষ করছেন লেখাটা।
কোনো ধর্ম - একজন প্রবক্তা, একটা বা কিছু নির্দিষ্ট 'পবিত্র' বই, কিছু প্রথা-বিশ্বাস - এই নিয়ে যাত্রা শুরু করে। তারপরে সমাজ আর কালের গতিতে তার নানা রূপভদে হয়, মিশ্রণ হয়, বিকার হয়, বিকারের থেকে ওঠার জন্য আলোড়ন হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার ব্যক্তিগত আগ্রহের বিষয় থাকে এই সমাজের সঙ্গে কোনো একটা বা অনেকগুলো বিশ্বাসের সমীকরণে আসার লড়াইটা। যা সমষ্টিগত অবচেতন মনের কি অসামান্য কারসাজি। কার্ল ইয়ুং-এর মত মরমী মনোবিদ ভারতে না জন্মালেও ভারত নিয়ে আগ্রহ ছিল তাঁর বিস্তর। কাজও করেছেন তাই। ভারতে এসেওছেন। কিন্তু সে অন্য গল্প।
একজন মানুষের যেমন অবচেতন মন থাকে, যা তার জ্ঞাত চেতনের নাগালের বাইরে, কিন্তু যা তার সমস্ত সজ্ঞান চেষ্টার পটভূমি, চালক ও গুপ্ত নিয়ন্ত্রক, তেমন একটা জাতেরও সমষ্টিগত অবচেতন স্তর থাকে। সেখানের ভাঙাগড়া আমাদের শিক্ষা-অভিজ্ঞতার বোধের বাইরে। কাকে সে রাখে আর কাকে সে ফেলে তা ডারউইনের মত “প্রকৃতির খেলা” বলা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। নেপথ্যে সে-ই ঘটিয়ে চলে সমাজের নানা পরিবর্তন। আমরা যার হাতে পুতুলমাত্র। বাইরের প্রকৃতি আর ভিতরের প্রকৃতি - এই দুইকে হাতে নিয়ে খেলছে সময়, মহাকাল। আমরা আটকে তার মধ্যে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “তোমার খণ্ডকালের ছোটো ছোটো পিঞ্জরে”।
মানুষ অস্ত্র দিয়ে যত না আঘাত করে মানুষকে, তার থেকে সহস্রগুণ আঘাত করে তার অহমিকা দিয়ে। যে অহমিকার নানা রূপের মধ্যে থাকে তার উন্নাসিক ধর্মবিশ্বাস, উন্নাসিক চামড়ার রঙে বিশ্বাস, তার উন্নাসিক সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্প ইত্যাদি সব দিয়ে আরেকজনকে কোণঠাসা করার আসুরিক প্রবৃত্তি।
ঝুঠন, ওমপ্রকাশ বাল্মিকীর লেখা তেমনই এক অত্যাচারিত হওয়ার রক্তাক্ত লেখা। ইংরাজিতে যাকে বলে, “ডিস্টার্বিং” লেখা। দীর্ঘশ্বাস আর কান্না পাতায় পাতায় পাঠকের মনে জাগতে বাধ্য যদি তার স্ব-বর্ণের কল্পিত মাহাত্ম্যর প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মে থাকে। অসহ্য বর্ণনা।
কদিন আগে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর জীবনী পড়তে গিয়ে পড়লাম, জীবনীকার লিখছেন তিনি নাকি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এক আসনে অব্রাহ্মণ বসলে বিরক্ত হতেন। অথচ যৌবনে তিনিই পৈতে ত্যাগ করে নিজেকে মানুষ হিসাবে সবার সমান, এক আসনে রেখেছিলেন। সাধন করে তিনি অনুভব করলেন বর্ণাশ্রম না টিকলে নাকি ভারতের সমাজ টিকবে না। এ শুধু বিজয়বাবুর মত না, সেই সময়ে নব্য সনাতনী সাধক ও প্রচারকদের সবার মধ্যেই এ বিশ্বাস জেগেছিল কমবেশি। রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে বিজয়কৃষ্ণকে নিয়ে লিখতে গিয়ে লিখছেন, “তিনি সত্যে স্থিতি লাভ কর্ত্তে পারেন নি, তিনি মত্ততা লাভ করেছিলেন”। কথাটা কঠিন, হয় তো রূঢ়ই বা। কিন্তু এই অদ্ভুত বর্ণাশ্রমে বিশ্বাস যে কি ভয়ংকর ছুঁৎমার্গী ব্যাধি সমাজে ঢুকিয়েছে তার সামনে যে কোনো কঠিন ভাষাই কম হয়ে যায়। আমি যে মুহূর্তে এই লেখাটা লিখছি ঠিক সেই মুহূর্তে ভারতের কোনো না কোনো প্রান্তে কোনো এক মানুষ তার নিম্নবর্ণে জন্মানোর মাশুল দিচ্ছে নিজের মর্যাদা, অধিকার, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সবটুকু খুইয়ে। কটা খবর কাগজে বেরোয়? যে মথুরা-বৃন্দাবন ভারতের মরমীসাধকদের এত বড় পীঠস্থান, তার থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরেই হাথরাস। ভুলে গেছি কি হয়েছিল সেখানে?
বুদ্ধ, মহাপ্রভু নিজেদের মত করে এর মূলে আঘাত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেদিনের বৌদ্ধ আর সেদিনের বৈষ্ণব আজকের দিনে অনেক অনেক পরিবর্তনে সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের কিছু। সবাই নয় যদিও। তবু মূলস্রোতে তো তাই। অসংখ্য শাখাপ্রশাখায় ভাঙতে ভাঙতে মূলে পৌঁছাতে আজ কালঘাম ছুটে যায় গবেষকের।
সাধনকমল চৌধুরীর লেখাটা পড়ার জন্য অনুরোধ জানালাম। করুণা প্রকাশনীর এই বই মাত্র ১২০ পাতার, দাম চল্লিশ টাকা। জানি না বইটা কদ্দিন আর পাওয়া যাবে। এ বই হারিয়ে যাওয়া মানে সত্যিই ক্ষতি। আর ঝুঠন লেখাটাও (যার ইংরাজি অনুবাদও পাওয়া যায়) পড়তে পারেন। অত্যাচারিতের প্রতি দরদে লেখা আর অত্যাচারিতের নিজের ভাষায় লেখার মধ্যে তো পার্থক্য থাকেই না?