মানুষের প্রকৃতিতে অব্যবস্থা নতুন কিছু নয়। অব্যবস্থা মানে বলছি ডিজর্ডার। মানুষের প্রকৃতিতে ডিজর্ডার আছে বলেই প্রোভোকেশান মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে একটা মুখ্য ভিলেন। মানুষকে প্রোভোক করা যেতে পারে - এ একটা অবাঞ্ছিত সত্য।
আজকে দুই দেশের মধ্যে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে তার বহুলাংশ জুড়ে এই প্রোভোকেশান। বিপ্লব, আন্দোলোন, প্রতিবাদ - এই শব্দগুলো ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। তার যথাযথ কারণ থাকে। একদল অত্যাচারিত হতে হতে, দীর্ঘদিনের লাঞ্ছনা সহ্য করতে করতে তার মধ্যে একটা শক্তি তৈরি হয়, তার জোরে সে রুখে দাঁড়ায়। তার একটা জাস্টিফিকেশান আছে। কিন্তু প্রোভোকেশানের মূল সম্বল - ঘৃণা। বিদ্বেষ।
সংঘাত যখন বিদ্বেষজাত, তার পরিণাম কোনোদিন মঙ্গল হয় না। সংঘাত যখন ন্যায়জাত, তার পরিণাম অবশ্যই শুভ। তার কারণ তার উদ্দেশ্যই ন্যায়গত।
দক্ষিণ এশিয়ার দুর্ভাগ্য হল তার ধর্ম উন্মাদনা। ধর্ম থাকবেই। কিন্তু তাকে ঘিরে উন্মাদনা সৃষ্টি করা মানে মানুষের ওই অব্যবস্থিত প্রকৃতিকে নিয়ে ধ্বংসাত্মক খেলায় নামা। দক্ষিণ এশিয়া যার সাক্ষী বারবার।
আমার ধর্মবিশ্বাস আমাকে দুই দিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এক বাইরের দিকে, দল-গোষ্ঠী নির্মাণ করে। দুই, ভিতরের দিকে নিজের প্রকৃতিকে মার্জিত, সুসংযত করার প্রেরণা দিয়ে। মহাপুরুষেরা বলে গেলেন দ্বিতীয়টাই হল আসল ধর্ম। কিন্তু মধ্যমেধা আর স্বার্থবুদ্ধিতে অন্ধ চেতনা বলল, দল বাড়াও, দলে আনো, এই হল জগতের স্রষ্টাকে তৃপ্ত করার আদর্শ উপায়। আর এই আদর্শই হল উৎকৃষ্টতম আদর্শ। সাধারণের ধর্ম সব সময়েই সুপারলেটিভ ডিগ্রিতে চলে। আমার ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ, এই হল মূল চালিকাশক্তি। মহাজনের ধর্মের মূল চালিকাশক্তি প্রজ্ঞা, করুণা, স্বার্থহীনতা। ক্ষুদ্রজনের ধর্মের মূল চালিকাশক্তি ঘৃণা, বিদ্বেষ, নিজেকে নির্ভুল অথোরিটি বিশ্বাস করার চূড়ান্ত মোহ।
বর্তমানে সমাজ দর্শনের একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হল - ইন্টারসেকশনালিটি। সমাজ মানুষের অন্তঃকরণের প্রতিফলন। যেখানে অন্তঃকরণই অব্যবস্থিত, সেখানে হাজার একটা পাঁচিল উঠবেই সমাজে এ অবশ্যম্ভাবী। রবীন্দ্রনাথ অত বছর আগে উগ্র ন্যাশেনালিজম এর নিন্দা করেছিলেন। ধর্মের উন্মাদনার মত, জিঙ্গোইজম একটা উন্মাদনা, যা দেশাত্মবোধের হাত ধরেই জন্মায়। কিন্তু ক্রমে তা অন্য দেশের উপর তীব্র, ঘৃণা আর বিদ্বেষে প্রতিফলিত হতে থাকে।
নানা ধর্মের সমন্বয় আর পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সহবাস নিয়ে ভারতের মাটিতে যত প্রচেষ্টা হয়েছে আমার জ্ঞানত বিশ্বের অন্য কোথাও এই মাত্রায় তা হয়নি। ধর্মের প্লুরালিজম আর বৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা পাশ্চাত্যে পণ্ডিতদের কাজ। কিন্তু এদেশে নিরক্ষর সাধক থেকে শুরু করে সাধক-কবিদের গানেও বারবার সমন্বয় আর সহনশীলতার কথা উঠে এসেছে। আধুনিক যুগে শ্রীরামকৃষ্ণ, রমণ মহর্ষি, শিরডির সাঁইবাবা প্রমুখ জনমানসকে প্রভাবিত করা সাধকদের জীবনেও একই সত্য প্রতিফলিত হয়েছে। এঁরা কেউ কোনো বই লেখেননি, কিন্তু জীবনের মূল কাজটাই ছিল মানুষের প্রকৃতির মধ্যে অন্যের আদর্শকে ছোটো দেখানোর নিম্নবৃত্তিকে দূর করা। মহাত্মা গান্ধী, নেহেরু, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষ বোস, অনুকূল ঠাকুর প্রমুখ লোকনেতাদের জীবনে, সিদ্ধান্তেও ভীষণভাবে একই সত্য প্রতিফলিত হয়। ফলে ভারতের মাটিতে একদেশী ধর্মকে কায়েমি করার চেষ্টায় কয়েকটা বিচ্ছিন্নমূলক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটলেও মূল ভাবটা সহনশীলতারই।
স্বাধীনতার পর থেকে ভারত গুরুত্ব দিল একটা বলিষ্ঠ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে। যার মূল কথা হল সর্বধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা। কিন্তু দুই প্রতিবেশী দেশে স্বাধীনতার পর থেকে সঠিক অর্থে গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হতে পারল না। সেক্যুলারিজম নিয়ন্ত্রিত সংবিধান আর ধর্ম শাসিত সংবিধানের মধ্যে যে পার্থক্য তা-ই ভারতের সঙ্গে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে হল। দুর্ভাগ্য যা, তা হল ওদিকে কোনো বাবাসাহেব আম্বেদকর জন্মালেন না। যে বাবাসাহেব হিন্দুধর্মের অত্যন্ত কড়া, কিছু ক্ষেত্রে রূঢ় সমালোচক ছিলেন, আমাদের পরম সৌভাগ্য যে তাঁর হাতে পড়ল আমাদের স্বাধীন দেশের ভিত্তি রচনার ভার। তার প্রতি ভারতের যে আনুগত্য তা যিনিই গত লোকসভা নির্বাচনকে কাছ থেকে লক্ষ্য করেছেন তিনিই অনুধাবন করতে পারবেন।
আজকে ভারতের মাটি ভীষণ দৃঢ় দুই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে, এক, ধর্মের নানাবিধ সমন্বয়ের সাধনায় অর্পিত জীবনের সত্যে আর দুই বাবাসাহেবের দ্বারা রচিত সংবিধানের প্রাণশক্তিতে।
রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার দায় সংবিধানের, আইনের। যদি তা সদুদ্দেশ্য নিয়ে বাস্তবায়িত করার শুভ ইচ্ছা থাকে। নইলে আফগানিস্তান আর নর্থ কোরিয়াও তো আছে উদাহরণ হিসাবে, রাষ্ট্রকে অমানবিক, বর্বরোচিত প্রবলের দ্বারা নির্মিত স্বেচ্ছাচারিতায় চালালে কী পরিণাম হয় তার। চীন, রাশিয়াও উদাহরণ আছে। গণতন্ত্র যদি ধর্ম অথবা কোনো দলীয় ক্ষমতার পায়ের নীচে বসে তবে তা দুর্দিনেরও বেশি।
আর একটা কথা হল, যদি রাষ্ট্রের নির্মাতাকে নির্লজ্জের মত গোটা বিশ্বের সামনে প্রকাশ্যে অপমান করতে না বাধে, তবে যে কাউকে অপমান করা অনেক সহজ হয়ে যায়। ওই যে বললাম, দুর্ভাগ্য সে দেশগুলো একজন আম্বেদকর পায়নি, পেলে হয় তো ইতিহাসটা অন্যরকম হত। কিন্তু প্রশ্ন আরেকটাও, আম্বেদকরকে ধারণ করার মাটিও কি আদৌ ছিল?