রুটি আমি গিয়ে না করলে, করবে?
লক্ষ্মী কথাগুলো বলতে বলতেই সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে, একলাফে উঠে পড়ল। লক্ষ্মী জেন্টস সাইকেল চালায়। বরের সাইকেল। বরের থেকে দুটো জিনিস পেয়েছে উত্তরাধিকারে। এক এই সাইকেল, আর দুই কুলাঙ্গার ছেলে একটা। রাতদিন নেশা করে পড়ে থাকবে। তাকে গরু খোঁজা খুঁজে নিয়ে এসো এ ভাগাড় সে ভাগাড় থেকে, বাবুর মুখে ভাত গুঁজে দাও। বমি পরিষ্কার করো। দূর দূর!
লক্ষ্মী রান্না করে তিন বাড়ি। তাছাড়া লোকনাথ ডেকরেটার্সের হয়েও রাঁধতে যায় অনুষ্ঠান বাড়িটাড়ি। রান্নার সুখ্যাতি আছেই বলা যায়।
সাইকেল চালিয়ে ফিরছে লক্ষ্মী। বয়েস পঞ্চাশ ছুঁলো প্রায়। মন যত দমে আসছে শরীর তত স্থূল হচ্ছে। লক্ষ্মী নিজেকে আয়নায় দেখে বলে, "গতর বাগিয়েছিস মাগী একটা!" হাসে। বরের ছবির দিকে তাকায়। অভ্যাস মত মুখ খারাপ করে। বর চন্দন কপালে তাকিয়ে থাকে নির্বিকার। বেঁচে থাকতেও যেমন নির্বিকার ছিল। চিনত শুধু মেয়েছেলে আর মদ। রেগে লক্ষ্মী বলত, তুই মরলে মিনসে তোকে হরি হরি না, মাগী মাগী বলতে বলতে, মদ ছিটিয়ে ছিটিয়ে নিয়ে যাবে পাড়ার লোকে।
রাস্তাটা অন্ধকার। পিছনে হঠাৎ রিকশার ভেঁপু শুনে অন্ধকারেও মুখে অল্প হাসির রেখা ফুটল। এই এক মানুষ, আজীবন তাকে পাহারাই দিয়ে গেল। সংসারে আর যেন কোনো কাজ নেই তার। বিজনদা। লক্ষ্মীকে বিয়ের কথা বলেছে, লক্ষ্মী রাজি হয়নি। আর বাঁধা পড়তে ইচ্ছা করে না। লক্ষ্মী জানে সুখ মানে রাতের পান্তাভাতে অল্প একটু লেবু, পেঁয়াজ আর নুন, তারপর মেঝেতে আলুথালু হয়ে ঘুম। শীতে অল্প একটু কাসুন্দি মাখানো রুটি আর একটা গোটা পেঁয়াজ, সঙ্গে এককাপ চা, তারপর বালাপোশের তলায় টানা ঘুম। এ সুখের ভাগীদার কাউকে চায় না লক্ষ্মী।
বিজনের রিকশার সামনের চাকা প্রায় সাইকেলের পিছনের চাকা ছুঁয়ে ফেলেছে। লক্ষ্মী বলল, বাড়ি যাও না….
বিজন বলল, শোন না, কাল বিয়েবাড়ি হয়ে যখন ফিরবি আমি আনতে যাব, বুঝলি, কাউকে কিছু বলিস না।
লক্ষ্মী আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। বিজন রিকশা থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। লক্ষ্মী সাইকেল থেকে নেমে বলল, কি হল?
বিজন বলল, কাল বলব।
====== ======
বিয়েবাড়ির কাজ সেরে যখন লক্ষ্মী রিকশায় উঠল শরীর আর দিচ্ছে না। বিজন শুধু বলল, চ।
বিজন কোন একটা রাস্তা দিয়ে চালাচ্ছে। এদিকে আসে না লক্ষ্মী। বলে নাকি এদিকে সব অশুভ আত্মারা ঘুরে বেড়ায়। সামনে ডোবা। পাশে বড় বড় দুটো বট গাছ। কত লোক যে গলায় দড়ি দিয়েছে তার অন্ত নেই। বিজন আনমনে প্যাডেল করে যাচ্ছে। অন্যদিন হলে তো তাকে গান শোনায়। আজ কি হল? বিজন খুব ভালো লোকগীতি, বাউল গায়।
তুমি ঠিক আছ?
না রে…. দাঁড়া সব বলছি।
বিজন ডোবাটার পাশেই রিকশা দাঁড় করালো। বলল, সর একটু। পাশে এসে বসল। পায়ের কাছে ডেকরেটার্সের কিছু হাঁড়ি-কড়াই আর হাতা। সঞ্জু পাঠিয়ে বলল, মাসি তুমি ক'টা নিয়ে যাও। ভালো ছেলেটা। বিপদে আপদে অনেকবার সাহায্য করেছে। তাই লক্ষ্মী না বলে না।
বিজন বলল, তুই আমার সঙ্গে ঘর তো করলি না…. আমিও আর কাউকে ঘরে আনলাম না…. তবে তোর এক সতীন এসেছে…এবার কি করবি?
চারদিক অন্ধকার। জোনাকি জ্বলছে এদিক ওদিক। যেন টুনি লাইটের দোকান দিয়েছে কেউ। ছেলেটাকে দোকানও করে দিতে চেয়েছে। সে অপগণ্ডটা যে কোথায়! চারদিন হল পাত্তা নেই।
লক্ষ্মী বলল, সতীন? কে গো?
বিজন বলল, আমার রক্তে রে। সে সেখানে বাসা বেঁধেছে। বলছি, কাল একবার আমার সঙ্গে হাস্পাতালে চ… তোরটাও পরীক্ষা করিয়ে নিই….
লক্ষ্মী চুপ করে থাকল। কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ওই এইডস না কি বলে, সেই?
বিজন বলল, হ্যাঁ। আমার কোনো ভয় নেই। তুই আমার সঙ্গে যাবি জানলে ভালোই লাগবে। এদিকে কি আছে আমাদের?
লক্ষ্মী বলল, আমার ছেলেটা?
মর্গে। দু'দিন হল।
লক্ষ্মীর বুকের ভিতরটা ফাঁকা বালতির মত শূন্য হয়ে গেল। এ আশঙ্কা তো রোজই করত। সত্যি তো হতই একদিন না একদিন। লক্ষ্মী বলল, তুমি কবে জানলে?
গতকাল। তোকে জানাইনি। আজকে আমার রিপোর্টটা আসার ছিল। আমি জানতাম পজিটিভ আসবে। তাই ভাবলাম তোকে দুটোই একেবারে জানাই।
লক্ষ্মী বলল, কি করে হল?
গাড়ি চাপা…
লক্ষ্মী বলল, থাক থাক। আমি যাব না… না যাব। আমি কাঁদছি না কেন দাদা? আমি কি মা গো?
বিজন লক্ষ্মীর মাথাটা কাঁধে টেনে নিল। বলল, কান্নার বাকি কিছু নেই আর। আর কাঁদলে ভগবান লজ্জা পাবে লক্ষ্মী!
তুমি এখানে কেন আনলে?
বিজন চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, আয়, নাম।
লক্ষ্মী বিজনের বাড়ানো হাত অন্ধকারেও দেখতে পেল। তারার আলোয়। হাতটা ধরে নামল। ক'টা কুকুর রিকশায় রাখা হাঁড়ি-কড়াই শুঁকছে। মাংসের গন্ধ পেয়েছে।
বিজন ডোবাটার পাশে এসে দাঁড়ালো। লক্ষ্মীর হাতটা ধরা। বলল, এ ডোবার গল্প তো আমরা জানি বল।
লক্ষ্মী কিছু বলল না। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বসে পড়ল মাটিতে। বিজনও বসল।
লক্ষ্মী বলল, এত তাড়াতাড়ি সব ছেড়ে চলে যাব? কি হবে বলো?
বিজন বলল, আমার হাতে তো সময় বেশি নেই রে লক্ষ্মী…. তোকে কার কাছে রেখে যাব বল? হাতটা বাড়া….
লক্ষ্মী বলল, বিষ?
বিজন বলল, হ্যাঁ। খা। তারপর চ ডুবি।
লক্ষ্মী চুপ করে। প্যাঁচা ডেকে উঠল কাছেই কোথাও। ডোবার জলে লাফালো কিছু একটা। তারার ছবিগুলো মিলিয়ে গেল ঢেউয়ে।
লক্ষ্মী বলল, পুরী যাবে?
বিজন বলল, কেন রে?
লক্ষ্মী বলল, দেখো, আমার শরীরে যদি তোমার দেওয়া বিষ এসেছে, তবে সে তোমার অজান্তে এসেছে। আমি ভালোবেসে সংসারে কম বিষ পাইনি, সে শুধু জ্বালা ধরিয়েছে বুকে। কিন্তু তুমি তো আমায় সত্যিকারের ভালোবাসো… বলো.. বাসো না? আমায় যদি ভালোবেসে বিষই দিয়ে থাকো সে আমার কাছে অমৃত। সব জেনেও তাই আমার প্রাণে কোনো জ্বালা নেই দেখো… আমি না হয় পরীক্ষা করিয়ে নেব। তবে তার আগে পুরী যেতে চাই একবার।
কিন্তু পুরী কেন?
আমি কোনোদিন সমুদ্র দেখিনি দাদা। জগন্নাথ দেখিনি। বাবার মুখে শুনেছি। বাবা সেখানে মারা গিয়েছিলেন। স্ট্রোকে। মা যেতে পারেননি। ওরা ওখানেই দাহ করেছিল। গরীবের লাশের ভার আর কে নেয় দাদা? আমি একবার স্বর্গদ্বারে যেতে চাই গো।
বিজন আর লক্ষ্মী চুপ করে বসে থাকল কিছুক্ষণ। খানিক বাদে লক্ষ্মী বলল, আমার হাতে দাও।
বিজন বিষটা দিল। লক্ষ্মী দু'জনের বিষ ডোবায় ফেলে দিল ছুঁড়ে। জল দুলে উঠল। তারারা দুলে উঠল। আরো কারা যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল, আচ্ছা আচ্ছা, বেশ বেশ, তবে তাই হোক।
লক্ষ্মীর বাড়ির সামনে রিকশা এসে দাঁড়ালো। লক্ষ্মী নামলো। হাঁড়ি-কড়াই বিজন তার ঘরের দরজা অবধি পৌঁছে, লক্ষ্মীর মুখের দিকের তাকালো। বলল, কান্না পেলে ডাকিস, একা কাঁদিস না।