Skip to main content
        স্যুটকেসটার উপর হাতদুটো জড়ো করে বসে আছেন। চোখে কার্বন ফ্রেমের হাই পাওয়ারের চশমা। উচ্চতা পাঁচ, সাড়ে পাঁচ হবে। গালে বয়েসজনিত ভাঁজ চামড়া কুঁচকে। ফর্সা গায়ের রং। সাদা চেক চেক হাফ হাতা জামা আর কালো একটা ফরম্যাল প্যান্ট পরা। 
 
        আসানসোল স্টেশান। সকাল দশটা। থিক থিক করছে ভিড়। মানুষটার চোখদুটো দূরে কোথাও আটকে। কিছু দেখছেন না। শূন্য তাকানো। একটা মাছি বারবার নাকের ডগায়, গালের পাশে বসছে। ওনার মুখের কোনো বিকৃতি নেই। 
        মাথাটা টিসটিস করছে। চা খেলে যেন ভালো হয়। উঠতে ইচ্ছে করছে করছে না। সামনে দিয়ে অনেকগুলো ট্রেন চলে গেল। মানুষের কত জায়গায় যাওয়ার থাকে। তার যেন কোথাও যাওয়ার নেই। আদৌ কি জন্য ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন সেটাও মনে নেই যেন। যেন এইমাত্র পৃথিবীতে জন্মালেন তার আগে কিছু মনে নেই। একটা বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব নিয়ে এই প্ল্যাটফর্মের একটা বেঞ্চে বসে আছেন যুগ যুগ ধরে। অপরিচিত হওয়ার সংজ্ঞা কি? কে পরিচিত তাঁর সংসারে? এতগুলো বছর নিজের সাথে কাটিয়েও নিজেকে কতটা চিনেছেন? কত ভাবনা ইচ্ছা বেজন্মা শিশুর মত মাথার মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে মরেছে। কতটা লালন-পালন করতে পেরেছেন তাদের? নিজের মধ্যে সে মৃত ভাবনাগুলোর হাহাকার শুনতে পান যখন তখন মনে হয় তিনি অনন্তকাল ধরে বসে আছেন এই বেঞ্চটায়।
        কাজের থেকে অবসর নিয়েছেন তা প্রায় দশ বছর হল। কাজের জগত আর সংসার এর বাইরে সারাজীবনে কয়েকটা ছুটকো ছাটকা বেড়াতে যাওয়া ছাড়া ঘটনা বলতে তেমন কিছু নেই। তিনি মরে গেলে কোন কাগজে কোন শ্রদ্ধার্ঘ্য বেরোবে না, কোথাও কোন মিটিং মিছিলে তার সম্বন্ধে কথা হবে না, পাড়ার বাজারে দোকানগুলো বন্ধ থাকবে না। একটা পিঁপড়ে মরে যাবার মত নিঃশব্দে মরে যাবেন। কয়েকজন মানুষ কাঁদবে, তাও যেন নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে। সারা জীবন যেন কতগুলো স্বার্থপর জীবকে জন্ম দিয়ে লালন করে পালন করে করে বেঁচে রইলেন তিনি। ওহ অসহ্য!! তবু সাহস করে এই লাইনে গলা দেবেন না। গত দু'বছর ধরে ভাবলেও দেবেন না। এই দুবছরে মাঝখানে আর না হোক দশজন মারা গেছে এই লাইনে কাটা পড়ে ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায়। তবু তিনি মরবেন না। তাকে লাইটের বিল জমা দিতে হবে, ফোনের বিল জমা দিতে হবে, মাসকাবারি বাজার করতে হবে, বউয়ের ওষুধপত্র কিনতে হবে, হাসপাতালে গিয়ে প্রতিমাসে নিজের চেকআপ করাতে হবে, তবু মরবেন না। একটা অর্থহীন জীবন, আনন্দহীন জীবন, যৌনতাহীন জীবন ঘাড়ে করে নিজের মৃত শরীরের মতো বয়ে নিয়ে বেড়াবেন তবু তার সৎকার করবেন না।
        ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মাছিটা চমকে উঠে উড়ে গেল। আবার এসে মাথার চুলে বসলো। তিনি উঠলেন না। নড়েচড়ে বসলেন না। মুখের পেশীগুলো শক্ত হয়ে যেন চিৎকার করে উঠে বলল "আর পারছিনা"!!! সামনের ট্রেনলাইনের তারে বসে থাকা তিনটে কাক উড়ে গেল। মৃত্যুকে ডাকছেন তিনি, মৃত্যু আসো, মৃত্যু আমায় নাও, মৃত্যু আমি প্রস্তুত। বুকপকেটে মোবাইল বেজে উঠল। ফোনটা রিসিভ করে শুষ্ক কণ্ঠে বললেন, "আসছি"।
        উঠে গেলেন। বেঞ্চটা ফাঁকা। মাছিটা বেঞ্চটার পিঠে একবার, হাতলে একবার, বসার জায়গায় একবার ঘুরঘুর করতে লাগলো। এক-একটা ট্রেনের announce হতে লাগলো। এক এক করে ট্রেন এল দাঁড়ালো চলে গেল। বেঞ্চে কতলোক বসলো উঠলো। আবার বেঞ্চটা ফাঁকা হল। মাছিটাকে অনেকক্ষণ দেখছিনা। মাছিটা কি কাটা পড়লো? মানুষটা এখন তার নিজের বিছানায় শুয়ে। মাথার উপর বন বন করে ঘুরছে পাখা। মাছিটা স্টেশন থেকে উড়ে উড়ে জানলা দিয়ে তার ঘরে এসে পৌঁছেছে। মশারির উপর বসে। 
        অন্ধকার ঘর। পাখার হাওয়ায় মশারিটা দুলছে। মাছিটা উড়ে উড়ে এ কোণায়, সে কোণায় বসছে। মানুষটা স্বপ্ন দেখছে। তিনি আগুন। দাবানলের মত সারা শহর পুড়িয়ে দিচ্ছেন। সব দাউদাউ করে জ্বলছে। কালো ধোঁয়া উড়ে উড়ে আকাশ অন্ধকার। সেই অন্ধকারে ঘোষণা হচ্ছে, ডাউন পুরী এক্সপ্রেস চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে। প্ল্যাটফর্মে কেউ নেই। তিনি একা। আর একটা মাছি। তার কানে বসে। পুরী এক্সপ্রেস আসছে। স্টিম ইঞ্জিন। পুরী থেকে আসছে। হঠাৎ সারা প্ল্যাটফর্ম সমুদ্রের জলে ভরে গেল। তিনি ডুবে যাচ্ছেন। শ্বাস নিতে পারছেন না। মাছিটার পা ধরে বাঁচতে চাইছেন। দম আটকে আসছে...
 
        ডাক্তার বললেন, ঘুমের মধ্যেই হার্টফেল হয়ে গেছে।