Skip to main content

যদিও আমরা কথায় কথায় খাজুরাহো, কোনার্কের মূর্তির দিকে আঙুল তুলে বলি, দ্যাখোদিকি আমরা কত উদার, কি নিষ্কাম দৃষ্টিভাবনা আমাদের, তবু মিন্ত্রার ভাগ্যে তা জুটল না। কদিন আগেই গয়নার বিজ্ঞাপন নিয়েও একই ঘটনা ঘটেছিল। 

      কেউ সে মানুষটাকে কেন বলল না, আপনার দৃষ্টিভঙ্গীটা বদলান। কারণ তাকায় চোখ, আর দেখে মন। আমাদের বয়েস যখন অল্প থাকে তখন আমরা সব ভাষাতেই একটা যৌনতার অনুষঙ্গ টেনে হাসাহাসি করি, মজা করি। যেমন কেউ হয় তো কোনো গ্রুপে জয়েন করতে চায়, সে সে কথা না বলে বলল, আমায় একটু ঢুকিয়ে দিস তো। ব্যস, অমনি অল্প বয়েসীদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। কেন না কথাটা আদিরসাত্মক হয়ে পড়ল। এ অভিজ্ঞতা আমাদের সবার কম বেশি আছে। সমস্ত কথাকেই আদিরসে জারিয়ে হাসির বস্তু করে তোলার জন্য একটা বয়েস লাগে, একটা বন্ধুগোষ্ঠী লাগে, একটা পরিবেশ লাগে। সেটা বোঝা যায়। অসঙ্গত ঠেকে না।

      কিন্তু কেউ যদি একটা লোগো, যা বহু অর্থ, শিল্পবোধ, বুদ্ধি খরচ করে, সময় দিয়ে বানানো, যা একটা কোম্পানীর আত্মপরিচয়, ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অঙ্গাঙ্গিভাবে - তাকে দেখে বলে এইটা দেখলেই মনে হচ্ছে যেন একটা দুষ্টু ছবি, এক্ষুণি বদলে দাও নইলে খেলব না...তবে সে নিতান্ত হাসির কথা হয়ে যায়। আর সারা দেশ যখন সেই দেখার বিকারকে ভাবাবেগ বলে চালায়, তা তখন চিন্তার কারণ হয়।

      আমাদের এখন সেই চিন্তার কারণ। ডিভাইড এন্ড রুল কথাটার গতি অতি সূক্ষ্ম। ডিভাইড অনেকভাবে করা যায়। একটা মানুষের ভাবনার সীমারেখা, শ্লীল-অশ্লীলবোধের সংকীর্ণ, স্থূল সীমারেখা গড়ে দেওয়ার অভ্যাস অচেতনভাবে করিয়ে দেওয়াটাও একপ্রকার ডিভাইড করা। একটা ভেদক তৈরি করে দেওয়ার কৌশল।

      ভারত নানাভাবে অধ্যাত্মিক হলেও, একদিকে প্রবল বস্তুগত। আমরা একটা প্রস্তরমূর্তিকে অনন্ত অসীম ধরে নিই, আমরা নির্দিষ্ট পর্বে নির্দিষ্ট নদীতে স্নানকে আত্মশুদ্ধি মেনে নিই, আমরা বিশেষ প্রাণীর বিষ্ঠাকে মূত্রকে শোধক বলি, আমরা কুশ একটা হাতে নিয়ে তাকে আত্মা বলি - অর্থাৎ মোদ্দা কথা আমাদের প্রতীক আর আসলে ভেদ হারিয়ে আমরা প্রতীককেই আসল বলে ধরে নিই। এইতে সুবিধা হয় এই যে, যে মানুষটা আচরণে সৎ না অসৎ ইত্যাদির দিকে না গিয়ে সে কতবার তীর্থে যায়, মন্ত্র বা নাম জপ করে, আরতি-ধুপ-ধুনো সহকারে পুজো করে, এইগুলো আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সে বাকি যাই করুক না কেন। অর্থাৎ আমাদের অধ্যাত্মবাদ মহাপুরুষদের জগতে নানা তত্ত্বে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জায়গায় গেলেও গণের কাছে তা কেবল প্রতীকী। সেই প্রতীক বস্তু। সেই বস্তুর মর্যাদা রক্ষা করাই আমার ধর্ম। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে আমরা সেই বস্তুবাদীই হলাম। খালি পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ পার্থিক জগতের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকিয়ে, আমাদের পরকালের। ফলে আমরা না পেলাম সঠিক অর্থে বস্তু সুখ, না পেলাম সত্য অর্থে ভাব আর নীতির আচরণের আত্মিক সুখ। প্রতীকী ধর্মে, প্রতীকী আচরণে প্রতীকী প্রসাদই পেলাম, যাও চিত্তের প্রসন্নতা না, ময়রার হাতে গড়া মিষ্টি।

      এই বস্তুবাদী সত্তার গায়ে হাওয়ার মত লেগে আমাদের ভাবাবেগ। থেকে থেকেই যা অপমানিত বোধ করছে আজকাল। আজকাল আমাদের ভাবাবেগে আঘাতটা বেশি লাগছে কারণ ওটা স্বাভাবিক মাপের থেকে বেড়েছে অনেকটা বেশি। শরীরের কোনো হাড় যদি বেশি বেড়ে যায় তখন সেটা থেকে থেকেই যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের ভাবাবেগটা আত্মসম্মানের আসনটা ফাঁকা পেয়ে এমন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যে ওটাকেই আমাদের আত্মসম্মান বলে বোধ হতে শুরু করেছে। ওর অযৌক্তিক অসঙ্গত হামবড়া ভাবকেই আমাদের ব্যষ্টি সমষ্টির কৃষ্টি বলে মেনে নিতে চাইছি আমরা।

      মিন্ত্রা’র লোগোটা আমি অনেকবার দেখেছি। আমার বন্ধুরাও অনেকবার দেখেছেন, কিন্তু আমার বা আমার বন্ধুদের কারোর মাথাতেই অমন একটা নারী অঙ্গের বোধ জন্মায়নি। আজ জন্মালো। লোগোটা বদলানোর আর্জি জানিয়ে সেই মানুষটি তার সঙ্কীর্ণ অস্বাস্থ্যকর দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে গোটা দেশকে কালিমায় ঢাকল। আজ সারা দেশ মিন্ত্রা’র লোগোকে নারী অঙ্গের প্রতিরূপ ভাবছে। কিন্তু এইসব ঘটার শুরুতে সত্যিই কি কেউ ছিল না যে ওনাকে বলবে, বাছা তোমার চিকিৎসার প্রয়োজন?