পরেশ সামন্ত "ধুর শালা, নিকুচি করেছে ঘুম" বলে উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে। বিছানায় ছারপোকা থাকলে মানুষ এমনিই দার্শনিক হয় - এমন একটা গভীর উপলব্ধি নিয়ে, ঘর্মাক্ত কলেবরটাকে ঘেমে যাওয়া বিছানা থেকে তুলে আবার বলল, শালা। মানদা ঘুমাচ্ছে। ঘুমাক। মূঢ় জীব!
রাত তিনটে। রাস্তায় পড়ে কুকুরগুলো ঘুমাচ্ছে। পরেশ সামন্ত জানলার পর্দা সরিয়ে উঁকি মেরে দেখে বলল, মূঢ়! বোতলে রাখা জল গলায় ঢেলে বলল, গরম! এত গরম জল, এতো হলাহল!
মানদা'র নাক ডাকছে। পরেশ সামন্ত মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে টেবিল থেকে 'বিবেকচূড়ামণি' বইটা বগলদাবা করে ছাদের সিঁড়ির পথ ধরল। আর কোথায় যাবে? মানে যেতে তো টাকা-পয়সা লাগে নাকি? আর টাকা-পয়সা আনার জন্য একটা চাকরিও তো লাগে। তো লকডাউনে সেটা যদি চলে যায়, সে দোষ নিশ্চয়ই তার না। বাড়িটা শিমুরালি থেকে উঠিয়ে তো আর বেলেঘাটা কি রাজারহাটে নিয়ে যাওয়া যেত না! অগত্যা চাকরিটাই গেল!
গেল তো গেল, বেশ হল। মানদা সেলাই করে, বড়ি দেয়। মেয়ে গান শেখায়। ছবি আঁকা শেখায়। কলেজে তৃতীয় বর্ষে সংস্কৃত নিয়ে পড়ে। বাবার থেকে শখ চেপেছে। তার ইচ্ছা সে নাকি পুরোহিত হবে। মস্তবড় পুরোহিত হবে।
মশা! হাওয়া নেই। গুমোট। ছাদের পাশেই স্ট্রিটলাইট। তার আলোয় ছাদে বইটা খুলে বসল। দূরে মালগাড়ি যাওয়ার শব্দ হচ্ছে। লকডাউনের মাল নিয়ে যাচ্ছে।
বিবেকচূড়ামণি থেকে পঞ্চকোষের তত্ত্বটা বার করেছে পড়বে বলে, হঠাৎ কে একজন বলে উঠল, আমারও ওসব পড়া আছে।
পরেশ সামন্ত চমকে উঠে বলল, কে? নবা?
গলা তো বিলক্ষণ চেনা। পাশের পাড়ার। নবারও চাকরি গেছে। আরে নবা তো গলায় দড়ি দিয়েছিল! সেই নবা!
হ্যাঁরে পরেশ। তোদের ছাদটায় বেশ হাওয়া খেলে। মরা ইস্তক আমি এই সময়টায় এইখানেই বসে থাকি। রোজই ভাবি, তুই যদি একটু উঠিস তো গল্প হয়। একা একা ভালো লাগে না।
পরেশ সামন্ত বইটা মুড়ে রেখে বলল, মুড়ি খাবি? আগে তো কত খেতিস।
তুই আমার শ্রাদ্ধে গেলি না কেন?
ধুর শালা, বন্ধুর শ্রাদ্ধে কেউ খায়…. তায় আবার অপঘাতে… কদ্দিন ঘুমাতে পারিনি জানিস। ঘুমালেই তোর মুখটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে বেড়াত।
জানি রে। সে ছাড়। তোকে কি আবার কাজে নেবে? শুনেছিস কিছু? ট্রেন তো আবার চলবে শুনছি।
তাই নেয়? আমার ফোনই ধরে না, এমনকি শেষ মাসের মাইনেটাই দিল না। আজকাল তো কত সুবিধা বল, টুক্ করে ফোনেই টাকা পাঠিয়ে দেওয়া যায়। তাও দিল না... শালা!!
হুম্।
দুই বন্ধু চুপ করে বসে। হাওয়া দিচ্ছে বেশ। সামনের ঝোপঝাড়গুলো হাওয়ায় হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠল যেন। পরেশ সামন্ত বলল, সারাদিন কি করিস?
সারাদিন হিসাব করি জানিস, কোথায় আমার কি ভুল ছিল। কেন এইভাবে জীবনটা শেষ করতে হল, সত্যিই কি আমরা কোনো দোষ করেছিলাম বল... কারোর কোনো ক্ষতি করেছি আমরা?
আমিও সারাদিন এই একই কথা ভাবি জানিস। কার কি ক্ষতি করেছিলাম বল….
সময়... বুঝলি... সময়টাই এরকম…..
আমার এক দাদু বাউল হয়ে গিয়েছিল জানিস। এখন ভাবি আমিও তাই হলেই ভালো হত...
হলি না কেন?
প্রথম কারণ আমার অর্শের ধাত, অর্শ থাকলে নাকি বাউল হওয়া খুব অসুবিধা। আর দ্বিতীয় তো তুই জানিস।
বৌদি….
সেই। কোন বাচ্চাবেলার সম্পর্ক বল। আচ্ছা, তোর সত্যিই কি আর কোনো উপায় ছিল না?
নারে। আমি অনেক ভেবেছিলাম। সব ভাবনাই জট পাকিয়ে যাচ্ছিল। তাছাড়া বৈশাখির সঙ্গে সম্পর্কটাও তিতে ছিবড়ে হয়ে যাচ্ছিল। ছেলেটা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, খরচ তো তুই জানিস…. আর টানতে পারছিলাম না…..
তা একদিক থেকে ভালোই করেছিস। বাড়ি যাস?
নাহ্! সব মায়া কাটিয়ে ফেলেছি।
আমি ছোটোবেলায় বুদ্ধের গল্প খুব শুনতাম জানিস। সেই যে বাইরে বেরিয়ে জরা, ব্যধি, মৃত্যু দেখে জগতের দুঃখের কারণ জানার জন্য বেরিয়ে গেলেন না?... আমার মনে হয় জানিস, মানুষ বেশি চিন্তা করলেই সুখের রাজত্ব ছেড়ে চলে যায়। বুদ্ধের মত হাঁটতে হাঁটতে সংসারের সব কদর্য কঠিন নিষ্ঠুর সত্যিগুলো সামনে চলে আসে। আমি বেশি ভেবে সংসারের অনেক বাইরে চলে এসেছি। তুইও।
কিন্তু বুদ্ধ তো হোসনি। তুইও না। আমিও না।
সে হইনি। ওই হওয়া যায়? তবে আমি বুঝি জানিস, তুই যত সুখের পিছনে দৌড়াবি, সুখ তত তোকে দৌড় করিয়ে মারবে। আমি আর সুখের পিছনে দৌড়াই না। দুঃখ যদি না চাইতেও আসে, সুখও তাই আসুক না হয়!
হেব্বি বললি তো।
ওইটুকুই তো সম্বল। আজব সব ভাবনা। বাস্তবটা বড় নির্মম রে।
পয়সা না থাকলে তো আরো…..
দুই বন্ধু আবার চুপ। মেঘ করে এল হঠাৎ। দেখতে দেখতে বিদ্যুৎ চমকিয়ে বৃষ্টিও শুরু হল।
পরেশ সামন্ত বই আর মোবাইল বগলদাবা করে বলল, "নীচে আয়... ভিজিস না"…. বলেই থমকে গেল…… ও ভিজবে কি করে?.... ওর ভেজার সুখটাও তো নেই….. ভীষণ জোরে কান্না পেল পরেশ সামন্তের। মানদা, পুঁটিকে ছেড়ে সে কোনোদিন যাবে না। সিঁড়ির দরজাটা দিয়ে নীচে নামতে নামতে বলল, সুখ না থাক, জীবনটা তো আছে। মানদা আছে। আর কিছু চাই না, কিছু না।