জোড়াতালি দিয়ে কোনো জিনিসই বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায় না। ইরার সামনে থেকে মৃত্যুনের মৃতদেহটা সরে যাওয়ার পর এই কথাটাই প্রথম মনে এসেছিল। ইরার বয়েস ছত্রিশ। মৃত্যুনের বিয়াল্লিশ। হঠাৎ মারা গেল, অসুস্থ ছিল যদিও। তবে এভাবে হঠাৎ চলে যাবে বোঝেনি কেউ। ইরার মনে হল সমাজে সে বিধবা হলেও আদতে মুক্তি পেল।
ইরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে হাজার একটা প্রশ্ন করত। উত্তর পাওয়ার জন্য নয়। প্রশ্নগুলোকে সশরীরে দেখার জন্য। নিজেকে যতটা অপরিচিত লাগত, সত্যিকারের অপরিচিত মানুষকেও ততটা অপরিচিত লাগত না। সংসারে বাঁধন বলতে, মুকুল, পনেরো বছরের ছেলে।
মৃত্যুনের সাথে ইরার সংঘাত বলতে যা বোঝায় তা কোনোকালে ছিল না। বিদ্বেষ ছিল। মৃত্যুন জীবনটাকে ভোগ করত না, যাপন করত। ইরার কাছে মৃত্যুন তাই অসম্পূর্ণ মানুষ। প্রতিটা মুহূর্তকে নিংড়ে রস বার করতে যেন জানে না মৃত্যুন, সে জানে প্রয়োজনের হিসাব রাখতে। মৃত্যুনের সাথে জড়ানো জীবনটা তাই কারাগার হল। কিন্তু কার দোষে কারাগার? সে তো অপরাধী নয়! অপরাধী যে সে তো সমাজে সংসারে সাধুত্বের তকমা লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কেন কারাগারে বাস করবে? কিন্তু মৃত্যুনের নামে সংসারে দোষ গাইবে সেরকম সামাজিক দোষ তার চরিত্রে কোথায়? বরং ইরার দিকে সমাজের ভ্রুকুটি ইরার চোখে এড়িয়ে যায়নি।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অনেকেই জানল, ইরার বাড়ির পিছনের দরজা অনেক রাতে খুলে যায়। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে যে ওঠে, বা যারা ওঠে, তারা কারা?
ইরার অবস্থা খুব স্বচ্ছল না হলেও দরিদ্র বলা যায় না। ইরার মায়ের এই বাড়িটা ইরা মায়ের মৃত্যুর পর নিজের বাড়ি করে নিয়েছিল। মৃত্যুনের বাড়ি ভাড়া দিয়ে। মৃত্যুনের আপত্তি শোনেনি। অবশ্য শেষ কয়েক বছর মৃত্যুনের শরীরের অবস্থাও ঠিক মাঠে নেমে লড়াই করার মত ছিল না। মৃত্যুনের তা করবার মত ইচ্ছা শরীর সুস্থ থাকলেও প্রকাশ করত কিনা সন্দেহের, হয় তো সে একাই সে বাড়ি থেকে যেত।
কথাটা ঠিক, ইরার বাড়ির দোতলার পিছনের দিকের ঘোরানো সিঁড়ি এখন মাঝেমাঝেই রাতে খুলে যেত। কিন্তু সে অবস্থাটা ইরার বেশিদিন ভালো লাগল না। শুধু সুখ আর সম্ভোগে ক্লান্তি এসে গেল খুব তাড়াতাড়ি। এতটা তাড়াতাড়ি হবে ইরা নিজেও বোঝেনি। ততদিনে ফোন নাম্বার বদলিয়ে বদলিয়ে সে ক্লান্ত। নিজেকে ছোটো লাগে এমন অবস্থায় দীর্ঘদিন স্বাভাবিক কেউ থাকতে পারে না। ইরাও পারল না। কোনো অনুশোচনা, গ্লানিকেও মনের মধ্যে বেশিদিন প্রশ্রয় দেওয়াও তাই ইরার স্বভাববিরুদ্ধ।
ইরার বিয়াল্লিশ বছর বয়েস হল। মৃত্যুনের চলে যাওয়ার বয়েস। ইরার নিজের জন্য, মৃত্যুনের জন্য করুণা বোধ হয় মাঝে মাঝে। ভাগ্যের কি রসিকতা যেন। উনিশে এপ্রিল। ইরা কি একটা বই পড়ছিল। তার প্রথম পাতাটা ছেঁড়া। উনিশে এপ্রিল তার প্রিয় সিনেমা। অনেকবার ভেবেছে যদি সত্যি মেয়েটা আত্মহত্যা করত তবে কি হত? অপর্ণা সেনের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে ভাবতে চেষ্টা করত। মুকুল ঘুমের ওষুধ খেয়ে মৃত। তার কি লাগত? মুক্তি না অপরাধ? কিন্তু কেন কোনো যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন হত না? এ প্রশ্ন বারবার করত। মুকুল এখন যুবক। বাইরে থাকে। ইরা একাই থাকে। হঠাৎ যদি মুকুলের মৃত্যু সংবাদ আসে, ইরা কি করবে? কাঁদবে? ভয় পাবে? অপরাধী লাগবে? ভালো মা হতে কোনোদিন চেষ্টা করেনি। ভালো মা হওয়ার ধারণাটা খুব মেকি লেগেছে। ভাণ করাটা স্বভাববিরুদ্ধ ইরার। তবে বিয়ে করাটাই কি ভুল হল?
উনিশে এপ্রিল নাকি কাদম্বরীদেবী আত্মহত্যা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বৌঠান। অত কম বয়সে একজন মানুষের চলে যাওয়ার পিছনে কি কারণ থাকতে পারে? ইরার সারাটা সময় জুড়ে থাকল কাদম্বরী। কিন্তু কোনো কারণে নিজেকে কাদম্বরীর জায়গায় দেখতে পেত না ইরা। শুধু মনে হত মানুষটা চলে যাওয়াতে ঠাকুরবাড়ির কি সত্যিই কোনো পরিবর্তন হয়েছিল? ইতিহাসের গতি কি অন্যরকম হত যদি কাদম্বরী বেঁচে থাকত? ঋতুপর্ণ'র সিনেমাটার নাম কেন ১৯শে এপ্রিল? কাদম্বরীর জন্য? নাকি অন্য কোনো কারণ!
ইরা লাইব্রেরী যেতে শুরু করল। ছোটো শহরের লাইব্রেরী, বই বেশি নেই। কিন্তু ইরা যেন কি একটা খুঁজছে। আত্মহত্যার নানা গল্প, প্রবন্ধ পড়তে শুরু করল। ঠাকুরবাড়ির উপর বই খুঁজল, যা পেল তাই পড়ল। মুকুল কিছু বই পাঠালো অনলাইনে। ইরা ডুবছে। আত্মহত্যার সার্থকতা কোথায়? প্রতিবাদ, না হেরে যাওয়া? ইরার নিজেকে ঘিরে নিজের একটা জগৎ তৈরি হতে যাচ্ছিল। হঠাৎ তাল কাটল আবার।
একদিন এক মাঝবয়েসী মানুষ এসে ইরার সামনে দাঁড়ালো। হাতজোড় করে নমস্কার করে বলল, আমি প্রদীপ, এখানকার স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক। আপনাকে দেখছি আপনি ঠাকুরবাড়ি নিয়ে বেশ কিছুদিন হল অত্যন্ত আগ্রহের সাথে পড়াশোনা করে যাচ্ছেন। আপনি কি কিছু বিষয়ে লেখালেখি করেন?
ইরার প্রথম কোনো পুরুষের চোখের দিকে তাকিয়ে নার্ভাস লাগল। চোখের দিকে তাকিয়েও চোখ নামিয়ে নিল। “তেমন কিছু নয়” বলে যেন পালিয়ে এল।
হঠাৎ করে তার দোতলার দুটো ঘর যেন বড্ড ফাঁকা হয়ে গেল। নীচের ভাড়াটেদের বাচ্চাটার কান্না শুনে কাঁদতে ইচ্ছা করতে লাগল। যাদের সাথে সে সব সংস্রব এড়িয়ে থেকেছে সেই ভাড়াটেদের বাড়ি মাঝে মাঝে যেতে শুরু করল। একটা হাপর টানার মত মন খারাপ বুকের ভিতরের সব সুখগুলোকে কুরে কুরে খেতে শুরু করল। আবার লাইব্রেরী গেল। আবার প্রদীপের সাথে কথা হল। কিন্তু প্রদীপ সামনে এলেই যেন তার মুখের উপর চড়ে বসে একটা মুখোশ। ইরা কোনোদিন মুখোশ পরা মানুষ সহ্য করেনি। আজও করে না। ইরার মনের মধ্যে কোনোদিন দুটো সত্তা জাগেনি। সে নিজেকে নিজে একাই ভোগ করেছে, চিনেছে। কিন্তু আজ তার মধ্যে কোন আদেখলা তার মুখের উপর জোর করে একটা মুখোশ আটকে দিতে চাইছে, কিসের জন্য? সংসারে কোন সুখটাকে সে চাখেনি? নিংড়ে তিতো করে তবে ছেড়েছে সবটা। কিন্তু সে তো অতীত। ইরা ভাবল, সে চাইলেই লাইব্রেরী যাওয়া বন্ধ করতে পারে। কিন্তু পারল না তো! উল্টে প্রদীপের ফ্ল্যাটে গেল। হ্যাংলার মত অপেক্ষা করল প্রদীপ কখন তাকে চুমু খেতে চাইবে। চাইল না। অপমানে ফুঁসতে ফুঁসতে বাড়ি ফিরল। অপমানের বোধটাকে অতিরঞ্জিত করে নিজের মনের সামনে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলল, তবু যাবি? মন বলল, হ্যাঁ যাব। কেন যাবি? কি পেলি তুই ওর মধ্যে? সম্মান জানানো সশ্রদ্ধ দৃষ্টি।
ইরা থমকে গেল। মনের মধ্যে এ কোন বিচারকের আসন পাতা, যে এত দরদী তার?
ইরা ছেলেকে হোয়াটস অ্যাপ করল,
বাবু আমি এবার ভাবছি তোর কাছে গিয়ে থাকব, তুই ব্যবস্থা কর।
মেসেজটা ডেলিভারড হল, দুটো টিকে। কিন্তু টিক্ দুটো নীল হওয়া অবধি অপেক্ষা করল না ইরা, অফলাইন হল। বুকের ভিতরটা হাপর পেটাচ্ছে। মোবাইলের কোণে চোখ গেল, 19th April