নীতিশ বাসের ঝাঁকুনিতে চমকে বাইরে তাকালো। বাইরেটা কুয়াশায় কুয়াশা। বাসটা আমডাঙা থেকে প্রথম ছাড়া বাস। নীতিশ এটাতেই কাজে যায়। বড়বাজারে একটা সোনার দোকানে কাজ করে। বয়েস আঠাশ। বিয়ে করেনি। স্কুলের পড়াশোনা এইট অবধি।
নীতিশ রোজ ঘুমিয়ে নেয় বাসে বেশ খানিকক্ষণ। আজও ঘুমটা জমে এসেছিল, হঠাৎ ঝাঁকুনিটা...
নীতিশের সামনে একজন বয়স্ক লোক বসে। পাঞ্জাবী ধুতি পরা। মুখটা মাফলার দিয়ে প্যাঁচানো। তার দিকে কুতকুতে চোখে তাকিয়ে আছে। রোগাটে গড়ন বুড়োটার, কিন্তু চোখের মধ্যে একটা ঔজ্বল্যতা আর তার সাথে দুষ্টুমি আছে। নীতিশ ফরজানার কথা ভাবছিল। অসভ্য কথা। মেয়েটাই অসভ্য। পাড়ার কতজনের সাথে যে... নীতিশ গলার তুলসীমালাটা একবার স্পর্শ করল... তারা বৈষ্ণব। অনেক ছোটো বয়সেই দীক্ষা হয়ে যায়। নীতিশের মনের মধ্যে দুটো ঘর আছে। একটা বৈষ্ণব ঘর, সেখানে সে ভালো চিন্তা করে, আরেকটা অবৈষ্ণব ঘর (নীতিশ বলে মালের ঘর) সেখানে সে অসভ্য চিন্তাদের রাখে। কোনো চিন্তার ঘরকেই সে বড় হতে দেয় না খুব বেশি। সে দেখেছে খুব বেশি হরিনাম করলে তার মাথা যন্ত্রণা করে। আবার খুব বেশী মেয়ে চিন্তা করলেও তার রাতে ঘুম হয় না। নীতিশ খুব ঝামেলায় পড়লে কৃষ্ণকে সমপর্ণ করে বিড়ি খায়। আর আরো বেশি ঝামেলায় পড়লে বাথরুমে, বা ঝোপেঝাড়ে যায়, কৃষ্ণকে পিছন ফিরিয়ে দু-তিন মিনিটে আগুন ঝরিয়ে নেয় শরীর থেকে। তারপর মনটা আবার ফুরফুরে হয়ে যায় তার, ঠিক যেন এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর তাদের আমবাগান।
নীতিশের সকালটায় ওই চিন্তাটা একটু বেশি হয়। যেদিন না হয়, সেদিন সে বোঝে হয় তার মন খারাপ না তো শরীরটা বিগড়াবে। ঠিক তাই হয়। নীতিশ আবার বুড়োটার দিকে তাকালো। সে এখনো তাকিয়ে আছে তার দিকে। নীতিশ দেখতে চেষ্টা করল লোকটার গলায় তুলসীর মালা আছে কি? দেখতে পাচ্ছে না। একটা লাল মাফলারে ঢাকা গলাটা। চন্দন আছে কপালে? আছে মনে হচ্ছে। একটু দূরে বসে লোকটা, ভালো বোঝা যাচ্ছে না।
নীতিশের মনে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয় মাঝে মাঝে, এইসব চিন্তা কেন তার সকাল হলেই আসে? সকালটা তো নামজপ করার সময়। নীতিশের নাম করতে ভালো লাগে না। তবু করে। ভয় পায়, কি জানি যদি চাকরীটা চলে যায়? কি কোনো কঠিন অসুখ হয়! থাক থাক। হরি...হরি...
নীতিশের মনে একটা অনুশোচনা হচ্ছে যেন। না আর এসব চিন্তা করবে না। ফরজানা, বুলু বৌদি, মুক্তা... সবাইকে এক এক করে মুছে ফেলতে চাইল মন থেকে। ওই মালের ঘরটাকেই সে ভেঙে ফেলবে আজ। ওর জন্যেই তার কোনো উন্নতি হল না। পড়াশোনায় এমন কিছু খারাপ মাথা তার ছিল না। তার বন্ধু, পরেশ, তাদের থেকেও গরীব, সে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ে এখন মুম্বাইতে কত বড় চাকরি করছে। আগামী বছর ও পাকা বাড়ি করবে, বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে নাকি ওর।
মদের মত একটা জ্বালাপোড়া ঈর্ষা তার বুকের ভিতর জ্বলেই নিভে গেল। বাইরে এখনো কুয়াশা। বাস ছুটছে। নীতিশ বুড়ো লোকটার দিকে তাকালো। সে চোখ বন্ধ করে আছে। নীতিশ দেখল সত্যিই ওর গলায় কণ্ঠীর মালা, ওর কপালে চন্দন। নীতিশের মনটা শুদ্ধ হতে চাইল। কলকাতায় ইদানীং সে বড্ড লাগামছাড়া জীবন কাটাচ্ছে। মাঝে মাঝেই মাল খাচ্ছে, ভুল পাড়ায় যাচ্ছে... একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল নীতিশ। অনুশোচনা করবার সময় এসেছে এবার। আর নিজেকে নিয়ে ওই পাপের রাস্তায় যাবে না সে। কিছুতেই না। মনের ভিতর একটা হাল্কা আমেজ তৈরি হচ্ছে তার। যেন ঠাকুরঘরের মত পবিত্র তার মনের ভিতরটা হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তার চোখ জুড়িয়ে এলো।
বাসের মধ্যে হুড়োহুড়িতে তার ঘুম ভাঙল। গন্তব্য এসে গেছে। ধড়মড়িয়ে নামতে গিয়ে সেই বুড়োটার সাথে প্রায় ধাক্কা লেগে যায় আরকি! বুড়োটা মাফলার খুলে ফেলেছে। কই তুলসীমালা। কপালে চন্দন নাতো! আরে এতো কাটা দাগ একটা। বুড়োটা বাস থেকে নেমে তার দিকে এগিয়ে এলো। এসে তার দিকে মিটিমিটি তাকিয়ে বলল, “কি গো ও পাড়ায় দেখি না যে... মালতী তো প্রায়ই তোমার কথা বলে... তোমার আদর না পেলে নাকি তার সোহাগ জ্বালা মেটে না...”
বুড়োটা হাসছে। সামনের দাঁতগুলোর ভিতর দিয়ে জিভটা একটা জন্তুর মত চলাফেরা করছে। খারাপ পাড়ায় পানের দোকান ওর... আফজল...
নীতিশের ঘোর ভাঙল কিসের যেন একটা। ঘরের ভিতর ফরজানা... বুলুবৌদি... আর মালতী...
নীতিশের এখন আবার দুটো ঘর। নাভির নীচের আর উপরের। একতলা আর দোতলা। নীতিশ ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল, আফজলও...
(ছবিঃ সুমন)