Skip to main content

সারারাত মদ খেল সে। মায়ের পুজোয় খায়। অভ্যাস। নেশা বাড়লে ভক্তি বাড়ে। ভক্তি বাড়লে মনে ক্ষোভ, রাগ সব যায়। বেলায় নেশা কাটে। আবার সব ক্ষোভ-রাগ এসে মন দখল করে। যেমন টিউবলাইটের নীচে সন্ধ্যবেলায় এসে দাঁড়ায় দুটো টিকটিকি।

নেশা কেটে গেছে। ভক্তি নেই। মন মড়া ব্যাঙের মত পড়ে আছে এক কোণে। যেন চাপা পড়েছে কাল রাতে। রাস্তা পেরোতে গিয়ে।

গোটা সংসার ঝিম ধরে আছে। এই এই

কেউ শুনবে না তো। শোনার নেই।

======

আজ আত্মহত্যা করবে। মা দুর্গা গঙ্গায় ডোবার আগে সে নিজে গঙ্গায় ডুববে। ভাসতে ভাসতে দূরে চলে যাবে। পচে যাবে।

কেউ ডাকল। মশায় এদিকে…. এই যে এদিকে…..

দুটো ছাগল নিয়ে বসে একজন। মাঝখানে। ছাগলদুটো তার দিকে তাকিয়ে। ঘাস না খাওয়া ছাগল দেখেনি আগে। এরকম তাকায় ছাগল? মাঝের লোকটা অন্ধ। আকাশের দিকে তাকিয়ে। এত আলো চাদ্দিকে, ওর চোখে মাল সব অন্ধকার। হাসি পেল। গঙ্গায় ডোবার আগে হাসি পায়? আত্মহত্যার আগে হাসে কেউ?

সে এগিয়ে গেল। একটা ছাগলের মাথায় হাত দিল। ছাগলটা মাথা নাড়িয়ে হাতটা সরিয়ে দিল। অন্ধ বলল, আমি ভিখারি নই, আমি মাতাল নই, আমি চোর নই, আমি নেতা নই, আমি কে তবে? আমি দুধ বেচি। এই ছাগল দুটোর। আজ খদ্দের পাইনি। আমার এই ঝোলার মধ্যে একটা ক্যান আছে। ওতে এই দুটো ছাগলের দুধ আছে। খাবেন? তারপর যা হয় দেবেন। আসলে আমার গুরুর নির্দেশ আছে। দুধ বিক্রি না করে গেলে অমঙ্গল হবে। একবার শুনিনি। রক্ত গরম ছিল, বয়েস অল্প। দিলাম সব দুধ ফেলে রাস্তার ধারে। বাড়ি গিয়ে শুনি বউটা অজ্ঞান হয়ে উঠানে পড়ে আছে। বাড়িতে হইচই। পেটের বাচ্চাটা মরে গেল। আমার বউও অন্ধ। আসুন দুধটা খেয়ে নিন।

======

মারা যাওয়ার আগে দুধ খাবে? পকেট হাতড়ে একটা দশ টাকার নোটের বেশি কিছু নেই দেখল। ঠকানো হবে তো। মরার আগে ঠকাবে? মরার আগে বিবেক জেগে ওঠে। বিবেক কি মৃত্যুজীবী? বেঁচে থাকতে বিবেকের উপর লোভের আঁচড়। লোভ মানে কি জীবন?

দশটাকা আছে।

চারা আনা হলেও চলবে। গুরুর কথা মানা নিয়ে কথা!

কে গুরু?

আহা! দাগী আসামী ছিলেন। সারা জীবনে গোটা ছাব্বিশের উপর খুন করেছেন। পুলিশ ছুঁতে পারেনি। আমার সঙ্গে মারা যাওয়ার আগে দেখা হয়েছিল। এই গঙ্গার বুকেই। খুব বৃষ্টি। লঞ্চে ভিক্ষা করি তখন। গান গেয়ে। সুর ছিল না গলায়। গাইলেই লোকে টাকা দিত। থামানোর জন্যে। গলায় সুর থাকলে লোকে গানে বিভোর হত। বিভোর হলে জীবনের দু:খকে তুচ্ছ মনে হয়। পয়সা দেয় না সবাই। বেসুরো হলে চিন্তার তাল কাটে। বিরক্ত হয়। তখন ভিখারি দেখতে ভালো লাগে। নিজের থেকে বেশি দু:খে কষ্টে কাউকে দেখতে ভালো লাগে। টাকা দেয় অনেকেই।

তো তিনি ছিলেন লঞ্চে। আমায় ডাকলেন। বললেন, বেচাকেনার দুনিয়া এটা। দুটো ছাগল কেন। দুধ বেচ। না বেচে বাড়ি যাবি না। অমঙ্গল হবে। জগতে নিজেকে বেচার জন্যে আসে মানুষ। তুই ঠকাচ্ছিস। এটা ভালো না। তোর গান হবে না। আমি কি করি জানিস? খুন করি। মানুষ খুন। এই শোঁক…..,

আমার নাকের সামনে হাতটা আনল। রক্তের গন্ধ।

জিজ্ঞাসা করলাম, কেন করেন?

উনি বললেন, মায়ের ইচ্ছা। তবে আর না। আজ আমার বিসর্জনের দিন। তুই আমার কথা ফেলিস না। মৃত্যুমুখী মানুষের কথা ফেলতে নেই। তবে একটা কথা জানিস, আমি কোনো ভালো লোককে খুন করিনি। আমি শুধু বাজে লোকেদের মারি। তাদের কাছে গিয়ে বলি তারা কি করে আরো দুর্ধর্ষ খারাপ কাজ অনায়াসে করতে পারত। কিন্তু ভয়ে করেনি। আর সেগুলো না করে নিজেদের কিভাবে বঞ্চিত করেছে। তারা নিজেদের ভয়ের কথা নিজেরা শুনে চমকে যায়। আমি টুক করে গলাটা কেটে দিই।

এই বলে তিনি গঙ্গায় ঝাঁপ দিলেন। আমার কানে আওয়াজ এলো।

=======

তার নেশা চড়ছে যেন আবার। দুধটা খেয়ে দশটা টাকা তার পকেটে গুঁজে বসে আছে কিছুটা দূরে। ছাগল দুটো ডাকছে। লোকটা বলছে, যাবি যাবি…. বাড়ি যাবি…. আগে এ লোকটা গঙ্গায় ঝাঁপ দিক…. দেখে যাই…

সে চমকে গিয়ে বলল, অন্ধ না আপনি? দেখবেন কি করে?

সে বলল, এই ডান দিকের ছাগলের চোখ দিয়ে। সাধনে সে শক্তি আমি পেয়েছি। এই ডানদিকের ছাগলটার চোখে আমি দেখি। যদিও ওর বাঁ চোখে ছানি পড়েছে। যাও যাও…. তুমি ঝাঁপ দাও… আমি দেখে যাই…..

সে ছাগলটার চোখের দিকে তাকালো। ছাগলটা স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। সে উঠে হাঁটল। যেদিকে হাঁটে ছাগলটা সেদিকেই তাকায়। সে বসে পড়ল। কিছু বলতে যাবে, হড়হড় করে সবটা দুধ বমি হয়ে গেল। কি টকটক গন্ধ!

======

সে ভাসছে। তার বুকের উপর লোকটা বসে। কি করে সম্ভব এটা! চারদিকে কেউ নেই। পেটের উপর ছাগলদুটো। একি! কি করে হচ্ছে। অন্ধ হাসল।

সে বলল, তোমরা আমার বুকের উপর কেন ভাসছ….

অন্ধ বলল, শালা অন্ধ নাকি! আমরাই শুধু… দেখ ভালো করে…..

সে দেখল তার বুকের ওপর তার বুড়ো বাবা মা, তার বউ, তার দুই মেয়ে বসে। সবাই তার দিকে তাকিয়ে।

তার মা হঠাৎ বলল, ডুবিস না বাবা! পেটে ধরেছিলাম দশমাস…. এভাবে ডুবে ডোবাবি বলে?

দুটো ছাগল তার পায়ের কাছে গিয়ে বুড়ো আঙুল কামড়াচ্ছে। ছোটো মেয়েটা হঠাৎ গলার কাছে এসে বসল। গালের উপর হাত রেখে বলল, কে বলল, নতুন জামা চাই? আমায় তুমি অষ্টমীর দিন বড় মাছের ঝোল আর ভাত খাওয়ালেই হবে।

অন্ধ বলল, দশমাস পেটে ধরেছে রে…. ডুবিস না… ওই দেখ…. ওঠ ওঠ….

সে বলল, আমার সময় নেই…. আমার আর ফেরার উপায় নেই… আমায় ডুবতেই হবে….

অন্ধ বলল, দশ দিকে দশ রাস্তা খোলা… রাস্তা নেই বললেই হবে?..... তাকা জলের নীচে….

সে দেখল দশটা হাত জলের তলায় নৌকা হয়ে তাকে ধরে আছে। দেখতে দেখতে তারা নোঙর হল।

অন্ধ বলল, আমরা আসি। ডোবার নেশা ছাড়। ভাসার নেশা ধর। ভেসে থাক। বুকে নিয়ে। ডুবিস যদি সব ডুববে। মাকে ধরে থাক। মা ছাড়া দশদিক দশ হাতে আর কে সামলায় রে!