Skip to main content


আজ ক্যালেণ্ডারে চোখ পড়তেই দেখলাম, ১৬ই জুন, তার নীচে লেখা একাদশী। পাশের ঘরে লেখা ১৭ই জুন, নীচে ছোট্ট করে লেখা - ২রা আষাঢ়। অর্থাৎ আজ পয়লা আষাঢ়! বর্ষামাসাবলীর প্রথম দিন। আলিপুরের হিসাবে নয় অবশ্যই। না হোক। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজের মধ্যে মেঘ করে আসতে লাগল, বড় বড় বৃষ্টির দানা চেতন মনের শার্সি বেয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে অচেতনের শুকনো উঠান ভিজিয়ে দিল। মাটির প্রথম ভেজা সোঁদা গন্ধ মেখে, কত কথা, চেনা মনের চেতন আঙ্গিনায় অসময়ে উপস্থিত। ফেরালাম না ওদের। ব্যস্ততার মধ্যে চোখের ইশারায় বললাম, খানিক বোসো আসছি।

ছোটবেলায় বর্ষা বলতে বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ছাদ ধোয়া জলের স্রোত, তাতে নাচের ছন্দে ভেসে যাওয়া ছোট বড় বুদবুদ। খবরের কাগজ, পুরোনো অঙ্কের খাতার ছেঁড়া পাতায় বানানো আমার, দিদির নৌকার চেনা পথে অচিনযাত্রা। সেই নৌকায় ভাসা আমার উৎসুক মন। কদ্দুর গেল?! ডুবে গেল কি? যাত্রীও থাকত নৌকায়, বারান্দায় চলে ফিরে বেড়ানো ছোটো ছোটো লাল, কালো পিঁপড়ে। তাদের বাধ্যতামূলকভাবে বেড়াতে পাঠানো হত। মনে মনে ভাবতাম ওরা নিশ্চই আমার উপর ভীষণ কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল, এই হঠাৎ করে বেড়াবার বন্দোবস্ত করে দেওয়ার জন্য!

বর্ষা তার বাইরের রূপ ছেড়ে ভিতরে আসল সেদিন, যেদিন গীতবিতান আসল ক্যাসেটবন্দী হয়ে বাড়িতে। ভাষার একটা আপ্যায়নের রীতি আছে। তা যতটা না ভাষায়, তার চেয়ে বেশী ভঙ্গিতে। গীতবিতানের ভাষা সেইদিকটা উন্মুক্ত করে দিল। বর্ষা আপ্যায়িত হল বাইরে থেকে ভিতরে। অর্থহীন শব্দমালা থেকে সুরের পরে সুরে।

যখন সে গৃহবন্দী করে তুলত তখন অনেক ভাবনাকে এমন অনায়াসে জাগিয়ে দিয়ে যেত, যাকে শুকনো প্রকৃতিতে পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শ্রাবণসন্ধ্যা প্রবন্ধে লিখছেন, 'প্রকৃতি আজ মুখরা হয়ে উঠল।' সারাদিনের ধারাবর্ষণকে তুলনা করছেন জপের মালার সাথে। প্রকৃতি যেন জপমগ্না।
এ তো গেল বর্ষার কাব্যিক সৌন্দর্যের কথা। আমি বন্যার কথা আনছি না, তাও রবীন্দ্রনাথের গানে আছে – বামে রাখো ভয়ংকরী বন্যা মরণ-ঢালা (বজ্রমাণিক দিয়ে গাঁথা আষাঢ় তোমার মালা)।
বর্ষার যেদিকটা বলছিলাম, ওই আগের সূত্র ধরেই বলি, তার মায়াবী ক্ষমতা হঠাৎ করে আনমনা করে তোলার। কলকাতায় যখন বাসে নানা কাজে যাতায়াত করেছি, তখনও দেখেছি যে মানুষটা পাশে বসে খানিক আগে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছছিল, সেই মানুষটাই, সেই ছাপোষা আটপৌরে মানুষটাই বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে বাসের জানলা দিয়ে। মুখের ওপর একরাশ স্মৃতির ভিড়। মনে পুরোনো দিনের কথার প্যারেড। এটা বর্ষাই পারে। প্যাচপ্যাচে রাস্তায়, হঠাৎ বিনা ভূমিকায় ভিজিয়ে, পাকাচুলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘আমি’কে ডেকে আনতে পারে। হারানো মুখ খুঁজে আনতে পারে। পুরোনো ভুলে যাওয়ার মত ব্যাথাকে জাগিয়ে আনতে। বর্ষা পারে। অভাবের সংসারে ঝুলকালিমাখা রান্নাঘরে গুনগুন গান ফিরিয়ে আনতে পারে হাতাখুন্তির তালে ছন্দে, তাও শুনেছি। বাইরে যখন অঝোর ধারা। বাঁধানো শ্যাওলা জমা দালানে তখন কেঁচো, ব্যাঙের রাজত্ব। তখন ঘরের খাটে আধখানা জানলা খোলা সজল কৌতুক চোখ দেখেছি। অপেক্ষায় না, স্মৃতির আলতো ছোঁয়ায়, ভেজা সুরে।
একটা ঘটনা মনে পড়ল। তখন বারোক্লাসে পড়ি। সকাল থেকে তুমুল বর্ষা। সন্ধ্যে গড়িয়েছে বেশ খানিক্ষণ হল। রেল কলোনির ফাঁকা ফাঁকা মাঠ, দূরে দূরে কোয়াটার্স। বর্ষার আওয়াজে, ব্যাঙের আওয়াজে বাইরের অন্ধকার কেমন অন্য সুরে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। এমন সময় মা বললেন, দোকানে যেতে হবে। এ তো বিশাল খবর। বাইরে বেরোবার ছুতোই তো খুঁজছি!
পায়ের পাতা ডুবিয়ে ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ তুলে, কিছু ব্যাঙকে চমকে দিয়ে দোকানের দিকে হাঁটছি। হঠাৎ কানে আসল একটা খুব করুণ সুর। থমকে দাঁড়ালাম। চারদিক মানুষের আওয়াজের পরিপ্রেক্ষিতে নিঃশব্দ। এর মধ্যে এমন গান! শব্দটা অনুসরণ করে এগোলাম। কলোনির শেষে বড়রাস্তায় পড়ার আগে একটা ঝুপড়ি। তাতে এক মহিলা আর তার দুই মেয়ে থাকতেন। মহিলা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন। মাথায় গোলমাল ছিল কিছুটা। তার কারণ বড় মর্মান্তিক। দেশভাগের সময় এতবার ধর্ষিতা হয়েছিলেন যে, তার নিজের ভাষায়, “ঘা শুকুবার সময় পেত না মা”।
তিনি গাইছেন। বাঙাল ভাষায় কোনো পল্লীগীতি। গানের চেয়ে কান্না যেন বেশি। সে কান্নায় ক্ষোভ নেই, অভিমানের কথাই যেন বেশি। পাশে রাখা লম্ফটা বাদল বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে, তাঁর দুটো পা সামনের দিকে ছড়ানো, চোখটা বন্ধ। অমন গান আমি আজ অবধি শুনিনি। আজ এতবছর হয়ে গেল, আজও যখন হঠাৎ মেঘলা আকাশে আমার বাড়ির সামনের বাগান কালো করে আসে, সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুলগুলো কালো মেঘের ক্যানভাসে তীক্ষ্ণ হয়ে চোখে ধরা দেয়, সে গান আমার কানে বেজে ওঠে...
বলছিলাম না বর্ষা অনেক কিছু পারে, ঠোঙার মত মনটাকে উল্টিয়ে, ভিতরের দিক বাইরে আর বাইরের দিক ভিতরে আনতে পারে, অজান্তে নিঃশব্দে।