সেদিন ছিল দরজা পুজোর আয়োজন। গ্রামের সব বাড়ির দরজা থাকবে বন্ধ। রাজপুরোহিত আসবেন রথে চড়ে। একে একে সব দরজা হবে পুজো। গৃহস্থের মঙ্গলের জন্য হবে যজ্ঞ। সব বাড়ির সব দরজা থাকবে বন্ধ। দরজা অতিক্রম করা স্পর্ধা সেদিন!
রাজপুরোহিত এলেন। শুরু হল যজ্ঞ। দরজা হোম যজ্ঞ। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে গৃহস্থের উলুধ্বনি, শাঁখের ধ্বনি, কাঁসরঘণ্টা বেজে উঠতে লাগল ক্ষণে ক্ষণে। এমন সময় যজ্ঞ প্রাঙ্গণে দেখা গেল এক বালককে। উৎসুক চোখে তাকিয়ে হোমানলের দিকে।
রাজপুরোহিত হলেন ক্রুদ্ধ। সাধারণের দৃষ্টিপাতে পণ্ড হবে যে যজ্ঞ! কে এ পাষণ্ড!
রাজপুরোহিতের অনুচর বলল, স্বামী, এ অনাথ এক বালক। এর না আছে ঘর, না আছে ঘরের দরজা। এ এমনই ঘুরে বেড়ায় পথে-ঘাটে-ক্ষেতে-প্রান্তরে। বৃষ্টিতে ভেজে। রোদে পোড়ে। শীতে কুঁকড়ে থাকে আস্তাকুঁড়েতে।
রাজপুরোহিত বললেন, এর ধর্ম কি? কি জাত?
অনুচর বলল, নেই স্বামী। জাতহীন। ধর্মহীন। এ বাউণ্ডুলে।
রাজপুরোহিতের ঠোঁটে খেলে গেল নিষ্ঠুর হাসি। বললেন, এর রুধিরেই হবে আজ আমার যজ্ঞ সার্থক। যাও, স্নান করিয়ে আনো ওকে।
রাজপুরোহিতের অনুচরেরা হইহই করে মেতে গেল। তাকে নিয়ে গেল দীঘিতে। খেলনার মত এ হাত সে হাত ঘুরে সে এলো যজ্ঞস্থলে, নগ্ন। উজ্জ্বল তার দুটো চোখ। বলল, একি খেলা গো? আমার রক্তে নাকি তোমাদের খেলা উঠবে জমে?
রাজপুরোহিত হাসলেন। বললেন, ওরে মূঢ়, নিজের গোত্র পরিচয় জানিস কিছু? আছে কোনো ঐতিহ্য ইতিহাসের পাতায়, দেখাতে পারিস মহাকালের কাছে? মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াস বাতাসের মত। যে বাতাসে ওঠে ঝড়। দরজা নেই। নেই আগল। নেই বাঁধন। সভ্যতার ভিত দাঁড়িয়ে স্থির ধ্রুব বিধিনিষেধের তপে, জানিস তা মূঢ়?
বালক বলল, মাকে জিগায়েছিলাম, মৃত্যুর প্রাক্কালে? আমার কোথায় ঘর? কার কাছে রেখে যাস মা আমায়? আপন বলে কে বল আছে কোথায়?
মা বললেন, এ বিশ্বজগত ঘর তোর বাছা। আগল টেনে, দরজা দিয়ে যা রচিস, সে ভ্রমের বাসা। ভ্রমিতে ভ্রমিতে বিশ্বমাতা বোঝাবে তোকে কি বিচিত্রতায় গড়া এ মাটি। আগল টেনে অতীত নিয়ে বাঁচে যারা, ভ্রম সাগরে স্বপ্নমানিক খোঁজে তারা। তোর আপনজন সেই সে হবে যার সঙ্গে দশদিকের আত্মীয়তা। হারজিতের ঊর্ধ্বে গিয়ে একা দাঁড়া।
রাজপুরোহিত আজ্ঞা দিলেন। অনুচরেরা বালকের হাত পা বেঁধে যুপকাষ্ঠে আনল বেঁধে। বালক বলল, এ তোমাদের কেমন খেলা?
যজ্ঞ হল শেষ। রাজপুরোহিত গেলেন ফিরে আপন রথে। গৃহস্থেরা বাইরে এলো দরজা খুলে। দরজা পুজোর প্রসাদী ফুল মাথায় নিয়ে বলল সবাই সমস্বরে, দরজার মান তখনই থাকে, যখন সে বন্ধ থাকে, খোলা দরজা অপমান তার, ঐতিহ্য, কৃষ্টি সব হারিয়ে হাওয়া তবে!
বালকের রক্তে ভেসে গেছে গ্রামের মাটি। সবাই বলল, এ রক্তের উপর মাটি লেপা কি উচিৎ হবে? নাকি বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাওয়াই ভালো হবে?
সবাই মিলে শাস্ত্র খুলল। শাস্ত্রে শাস্ত্রে বিবাদ হল। দিনের পরে দিন গেল। মাসের পরে মাস গেল। রক্ত আরো উজ্জ্বল হল। রক্তকরবীর গাছ ছিল না গ্রামে কোনোদিন। কিন্তু সেদিন থেকে রক্তকরবী ভরে গেল। গাছের পরে গাছ কাটা হল। দরজাদেবী প্রতিষ্ঠা হল। বন্ধ দরজার স্তব লেখা হল। কে কতযুগ রাখতে পারে বন্ধ দরজা, সেই তপস্যায় কত লোক এলো। তবু এখানে সেখানে রক্তকরবী আবার হল। আবার কাটতে আবার হল।
রাজপুরোহিত বিধান দিলেন, রক্তকরবী নস্যাৎ করবে যে, সে সোনার দরজা উপহার পাবে। যে দরজা কোনোদিন কেউ খুলতে পারে না। এমন মন্ত্রপুত সে পাল্লা হবে। আগল খুলে অনাচার না বাড়িয়ে, আগল দিয়ে গর্ব করো। যা ভাবো তা আপনি পাবে। আসল জগত কল্পনাতে। বাস্তব যা মিথ্যা সেটা। এই ধাঁধাটা বুঝতে হবে। তবে জীবন সার্থক হবে। বন্ধ দরজার ভক্ত হও, সব প্রশ্ন মরে যাবে, অখণ্ড শান্তিতে জীবন তোমার ভরে যাবে। মুক্ত বাতাস, অশুচি জেনো। অতীত থেকে শুদ্ধ বাতাস আনতে হবে। পুণ্যঘটে অতীত পল্লব জাগাতে হবে। তবেই তুমি শুদ্ধ হবে। শুচি হবে। সার্থক হবে।