সৌরভ ভট্টাচার্য
17 June 2020
অনেকবার অনেকে জিজ্ঞাসা করেছেন, "কোন বই আপনার জীবনে পথের দিশা দিয়েছে?"
আমাকে এর উত্তর ভেবে বলতে কোনোদিন হয়নি, আজও হয় না। উত্তরটা সোজা - অবশ্যই রেলের টাইম টেবিল। মোটা মোটা বেশ চৌকোপানা বই দেখলেই কি খুশিই না হতুম ছোটোবেলায়! এখনও হই, থুড়ি হতাম, এলো যে করোনাবেলা - ভুলে গিয়েছিলাম। তো সেই বইগুলোতে কত কত ট্রেনের কথা! শুধু যদি বলো ৭ নাম্বার চার্ট, হবে না। ৭ নাম্বার চার্টের আবার A B C ইত্যাদি আছে। সূচীপত্রটিও কি মনোরম। স্টেশান অনুযায়ী লিস্ট, আবার ট্রেন অনুযায়ী লিস্ট।
স্কুলের ছুটির সময় উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে, বিশেষ করে দুপুরবেলায়, একটার পর একটা স্টেশানের নাম পড়ছি, ম্যাপবই খুলে জায়গাটা দেখার চেষ্টা করছি, বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু সব স্টেশান কি আর ম্যাপবইতে থাকে? মনে মনে ভাবছি, একটা ছোটো স্টেশানে দাঁড়িয়ে আছে আমার টাইম টেবিলের ট্রেন। তার একটু দূরে প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমেই একটা গুমটি সিগারেট-বিড়ির দোকান, যেখানে কোল্ডড্রিংক্সও পাওয়া যায়, তার সামনে একটা কুকুর লেজ গুটিয়ে শুয়ে। না হয় দোকানের উপর একটা বড় বটগাছ, সেই বটগাছে বেশ কিছু ব্যস্ত হনুমান। রেলগেট পড়া আছে, কয়েকটা বাইক, লরি অপেক্ষা করছে, আমাদের ট্রেনটা গেলেই গেট খুলবে, তারা হুশ করে বেরিয়ে যাবে। রাস্তার একদিকের মাথায় একটা ছোটো শহর। বাংলার বাইরের কোনো শহর। নীল, সবুজ বাড়ি। সামনে খাটিয়া পাতা। দোকানের গায়ে হিন্দীতে কি গুজরাটিতে কি উড়িয়াতে কিছু লেখা। প্রচণ্ড রোদ, লোকে মাথায় কাপড় জড়িয়ে হাঁটছে। রাস্তাটা রেললাইনের বুকের উপর দিয়ে গিয়ে ওই দূরে এঁকেবেঁকে হারিয়ে গেছে। সেখানে বাস যাচ্ছে। দূরপাল্লার বাস। যে বাসে উঠলে বমি হয় না। খুব জোরে যখন চলে রাস্তায় চিক চিক আওয়াজ হয়। সবাই শুনতে পায় না। যারা ঘুমায় না তারাই শুনতে পায়।
এইসব দেখতে দেখতেই ট্রেনের হুইশেল বাজল। ডিজেল ইঞ্জিনের হুইশেল, পং....... কাঁপা কাঁপা আওয়াজ।
ট্রেনে দুলুনি লাগল। ট্রেনটা ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। অল্প অল্প ধুলো উড়ছে। বাচ্চারা টাটা করছে। আমিও করছি। আবার নতুন কোনো জায়গা দেখার উত্তেজনা। বড় ব্রিজ আসবে, টানেল আসবে, জঙ্গল আসবে। এ সব ম্যাপে লেখা নেই। কিন্তু পরের স্টেশানের নাম লেখা আছে। এমন কি যে স্টেশানে দাঁড়াবে না, তার নামও লেখা আছে। কেন লেখা আছে? বা রে, থাকবে না? টাইম টেবিলে আমি মনে মনে যে এক্সপ্রেস ট্রেনে যাচ্ছি সে তো সুপারফাস্ট। সিগন্যাল না পেয়ে এই ছোটো স্টেশানে দাঁড়িয়েছিল। টাইম টেবিলে সেই 9A পাতায় আমার ট্রেনের পাশের সারিতে যে ট্রেন সে তো শুধু এক্সপ্রেস, তাই সে কোথায় কোথায় দাঁড়াবে বলতে হবে না? সে আমার চলে যাওয়ার চার ঘন্টা দশ মিনিট পর আসবে, লেখা আছে।
এইভাবেই টাইম টেবিল আমায় বহুবার পথের দিশা দেখিয়েছে। আজ দেখায় নানা ওয়েবসাইট, 'কোথায় আমার ট্রেন' অ্যাপ ইত্যাদিরা। ওই দেহটুকুই বদলেছে, আদতে কাজ একই - দিশা দেখানো।