মাছ বিক্রি হয়ে গেলে গামলা-হাঁড়ি ধুতে বসল বগাই পুকুরের ধারে। লুঙ্গিটা হাঁটু অবধি তুলে, গায়ের ঘেমো জামাটা পাশে ঘাসের উপর মেলে ঘসঘস করে গামলা ঘষছে বগাই। পিছনে ভ্যানটা রাখা। ভ্যানের উপর তিনটে বেড়াল মাছের গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছে। মাছের জল চাটছে।
বগাই ধোয়া গামলায় জল ভরে বেড়ালগুলোকে বলল, হ্যাট… হ্যাট….
বলেই জলটা ছুঁড়ে ভ্যানটা ধুলো। বেড়ালগুলো বগাইয়ের পায়ের কাছে নীল-কালো চেক চেক লুঙ্গিটা ঘেঁষে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বেলা বারোটার কাছাকাছি হবে। খিদে নেই। কিন্তু চা-তেষ্টা পাচ্ছে। সোনা এত তাড়াতাড়ি চায়ের দোকান বন্ধ করল কেন কে জানে? এই তো পুকুর থেকে হেঁটে গেলেই ওই যে মোড়, সারের দোকান, ওর পাশেই সোনার চায়ের দোকান। কাছাকাছি আর কোনো চায়ের দোকানও নেই।
বগাই পা ছড়িয়ে পুকুরের দিকে মুখ করে বসে আছে। চায়ের তেষ্টাটা কমছে। বগাই ভাবতে চেষ্টা করছে আজ মা কি রেঁধেছে। বগাইয়ের মা ছাড়া সংসারে কেউ নেই। মায়ের বয়েস হয়েছে আশির উপর। বগাই বিয়ে করবে না। কারণ আছে। বগাই যখন ছোটো, বগাইয়ের বাবা বাজির কারখানায় কাজ করত। একবার কি সাংঘাতিক বিস্ফোরণ হল। বগাইয়ের বাবা সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল। বগাই গিয়েছিল বাবাকে খাবার পৌঁছাতে। বগাইয়ের সারা মুখ, হাত পুড়ে গেল।
তারপর তো থানা-পুলিশ কত কি হল। ওটা নাকি বে-আইনি কারখানা ছিল। কি করে ছিল বগাই বুঝল না। কারণ বড়বাবুই তো কালীপুজোর আগে ছেলের জন্য কম দামে বাজি কিনে নিয়ে যেত। অখিল মামা কত বাজি ফ্রি-তে দিত। তাদেরকেও দিত। সেই অখিলমামা সেই যে পালালো আর ফিরে এলো না। এখন ওই বাজির কারখানায় পার্ক হয়েছে। সুকান্ত পার্ক।
তো এই পোড়া মুখ নিয়ে বগাই বিয়ে করতে চায় না। ছেলেমেয়ে তার মুখ দেখলে ভয় পাবে না? কি বলবে সবাই, ওই দেখো পোড়ামুখো বগাইয়ের মেয়ে যাচ্ছে…. ছেলে যাচ্ছে…..
বগাইয়ের চোখে জল এলো। না হওয়া ছেলেমেয়ের কথা ভেবেই জল এলো। বগাই নিজের ছেলেমেয়ে ভাবলেই মেয়ের কথা কেন ভাবে কে জানে? একটা নীল ফ্রক পরে তার বুকের উপর বসে আছে, তাদের উঠানে খেলা করছে, ছোটো-ছোটো হাতে ভাত খাচ্ছে। বগাইয়ের গাল গড়িয়ে জল নামল। মুছল না। বড় অভিমান হয়। এই দুনিয়ার মালিকের উপর বড় অভিমান হয়। কেন তার জীবনটা এত কঠিন করে দিল? কেন? অভিমানে চোখের জল মুছতে ইচ্ছা করে না। কেউ তো নেই দেখার…. এই পুকুর আর সামনে ওই ঝোপঝাড় ছাড়া। কেন বগাইকে সুখী করল না দিনদুনিয়ার মালিক? সে তো কারোর ক্ষতি করেনি। না তার মা করেছে। তবে? লোকে বলে গতজন্মে নাকি অনেক পাপ করেছে। হতে পারে। তা সেগুলো তো দিনদুনিয়ার মালিকের মনে করিয়ে দেওয়া উচিত। তবে তো একটা সান্ত্বনা থাকে। কিন্তু একি অবিচার!
"কাকা…. বাবা তোমায় ডাকছেন……”
বগাই চমকে পিছন ফিরে তাকালো। একটা পাঁচ কি ছ'বছরের মেয়ে, নীল ফ্রক পরে দাঁড়িয়ে। তার দিকে তাকিয়ে আছে, কি চোখ গো…. যেন দুটো মণি! এক মাথা ঝাঁকড়া চুল। রঙটা চাপা। মুখটা……
বাবা আমাকে বলল, তোমায় ডেকে আনতে…. তুমি বগাই কাকা তো….. বাজারে মাছ বিক্রি করো….. বাবা বলল, এই সময়ে তুমি পুকুরে বসো…. তারপর বাবার দোকানে চা খাও…. বাবা ডাকছে…. বাবার খুব জ্বর…..
বগাই কথা বাড়ালো না আর। মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বলল, তোর নাম কি মা?
সে বলল, ডাক নাম জোনাকি…. ভালো নাম আরতি সাহা।
জোনাকি নাক কুঁচকিয়ে বলল, কি মাছের গন্ধ গো…. তোমার গা গুলায় না?
বগাইয়ের মনে হল, ইস্..., যদি সে অন্য কিছু বিক্রি করত…. ফুল… কিম্বা সব্জী……
বগাই জোনাকিকে ভ্যানে বসিয়ে, একদিকে গামলা-হাঁড়ি চাপিয়ে বলল, চ… আমার দিকে সরে বস…. নইলে গন্ধ করবে ওদিকে…..
=======
একটা ছোটো টালির বাড়ি। ভিতরটা অন্ধকার। জোনাকিকে কোলে নিয়ে মাথাটা নীচু করে ঘরে ঢুকল বগাই। সব আলো-আঁধারিতে ধাঁধিয়ে গেছে। জোনাকি কোল থেকে নেমে বলছে, বাবা… কাকা এসেছে…. ও বাবা…..
ধীরে ধীরে দেখতে পেল বগাই। সোনা একটা কম্বল ঢাকা দিয়ে শুয়ে চৌকিতে। ঘরের একদিকে স্টোভ, থালাবাসন, আরেকদিকে আলনা। একটা টেবিলে টেবিল ফ্যান রাখা। বন্ধ। ঘরটা বেশ গুমোট হয়ে আছে।
সোনা উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না। ক্ষীণ গলায় বলল, দাদা, আমাকে ডাক্তার বলেছে হাস্পাতালে না ভর্তি হলে আমি নাকি সারব না…. এ ভালো জ্বর না। এদিকে ওর মা গোসাবায়, বাপের বাড়ি, ওর বাবার ক্যান্সার, এই যায়, সেই যায়। ওকে আসতে বলি কি করে? এ মেয়ে জেদ করে ওর মায়ের সঙ্গে গেল না। কিন্তু এখন আমি কি বিপদে পড়েছি বলো তো…. এই পায়রাডাঙা থেকে গোসাবার রাস্তা তো বড় কম না। তুমি ওকে একটু ওর মায়ের কাছে রেখে আসবে? আসলে তোমায় ছাড়া…. আমি আসলে ভরসা করতে পারছি না…….
=======
সোনাকে বগাই গিয়ে কল্যাণীর জওহরলাল হাস্পাতালে ভর্তি করে এলো। জোনাকির মা-কে ফোন করে বলল কাল নিয়ে আসতে পারতো… কিন্তু একটা বিয়ে বাড়ি ধরা আছে… তাদের মাছ দিতে হবে।
বগাই এতবড় মাছের ব্যবসা করে না যে বিয়েবাড়িতে মাছ দেবে। কিন্তু সে চায় জোনাকি অন্তত দুটোদিন তার কাছে থাকুক। তার বিছানায় ঘুমাক। তার হাতে মাখা ভাত খাক। তার সঙ্গে গল্প করুক। বাজারে গিয়ে দুটো ফ্রক, একটা পুতুল আর চুড়ি-টিপের পাতা কিনে দিল। জোনাকিকে বলেছে তার একটা কাজ আছে, তাই পরশু যাবে গোসাবা। জোনাকি বলল, আচ্ছা।
=======
শিয়ালদা সাউথে বসে আছে। ট্রেন দেরি আছে। জোনাকি তার কোল ঘেঁষে বসে। বগাইয়ের এই দু'দিন কি ঘোরে কেটেছে। মা আসার সময় জোনাকিকে জড়িয়ে আদর করল। কেঁদেই ফেলল। বলল, আবার এসে থাকিস মা।
জোনাকি বলল, আসবই তো….
কিন্তু জোনাকি একটাবারও তার পোড়ামুখের কথা জিজ্ঞাসা করল না। বগাই দেখত সে যখন কাছে মুখটা নিত, জোনাকিকে চুমু খাবে বলে, ও কোনো আছিলায় সরে যেত।
বগাই জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, একটা কথা বল তো…. আমার মুখ-হাত কেন এরকম জিজ্ঞাসা করলি না তো একবারও…..
জোনাকি সামনের দিকে যেমন তাকিয়ে ছিল, তেমন তাকিয়ে থেকেই বলল, বাবা বলেছে ওসব প্রশ্ন তোমায় না করতে… ছোটোবেলায় বাজি পুড়াতে গিয়ে তোমার মুখ-হাত পুড়ে গেছে নাকি…..
তাই?
জোনাকি এই প্রথম সোজাসুজি তাকালো বগাইয়ের মুখের দিকে। কি একটা বিঁধছিল বগাইয়ের নিজের মধ্যে…. এতক্ষণে স্পষ্ট হল। মেয়েটা এসে ইস্তক স্বাভাবিকভাবে তাকায়নি…. এই প্রথম তাকালো……
বগাই মুখটা ঘুরিয়ে নিল। সামনে সাজানো দোকান। কেক বিক্রি হচ্ছে। বগাই উঠে দুটো কেক কিনে আনল। জোনাকি বসে বসে তাকে খেয়াল করছে। বগাই কেকদুটো তার হাতে দিয়ে বলল, এখন খাবি? না পরে?
জোনাকি কেকটা হাতে নিয়ে পাশে রেখে, বগাইয়ের পোড়া হাতের উপর নিজের ছোট্ট হাতটা রেখে বলল, ব্যথা?
বগাইয়ের হাতে এত আদর করে কেউ হাত রাখেনি।
জোনাকি চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে, বগাইয়ের গালে, কপালে হাত বুলিয়ে বলল, ব্যথা?
বগাই কোলে নিয়ে নিল জোনাকিকে…. অনেক কিছু বলার আছে...সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চারদিক যে….. কিন্তু ক্যানিং লোকাল অ্যানাউন্স হয়ে গেল যে….