Skip to main content


আদি কথা
----------
       বেলো যে মিথ্যা বলত তা নয়। মিথ্যাকে সত্যি ভেবে বিশ্বাস করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল ওর মধ্যে। মিথ্যাকে সত্যি জেনে বিশ্বাস করা আর সত্যি মেনে বিশ্বাস করার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথমটা অজ্ঞতা। দ্বিতীয়টা হয় দুর্বলতা, না হয় চালাকী।
      বেলো সেটা বুঝত কিনা জানি না। ছোটবেলা থেকেই তার এ প্রতিভার বিকাশ। তার এ স্বভাবের জন্য তার মা, ভাই, বোন খুব মুশকিলে পড়েছে অনেকবার। সে সব উদাহরণ দিতে গেলে সম্পূর্ণ একটা উপন্যাস হয়ে দাঁড়াবে। তার চেয়ে মিথ্যাগুলোর প্রকৃতি কিরকম পর্যায়ের হত, তার কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন বেলো মাস্টারের কাছে পড়তে না গিয়ে হয়তো খেলতে চলে গেল। ফিরে এসে বলল, মাস্টারের মা মারা গেছেন আজ সকালেই। পরে কোনো কারণে বেলোর মায়ের বা ভায়ের বা দিদির সাথে মাস্টারের দেখা হলে তাদের নিতান্তই অপ্রস্তুত হওয়ার মত অবস্থা।
      তখন বেলো ক্লাস সেভেনে পড়ে। স্কুল থেকে ফিরে এসে বলল কাল স্কুল থেকে ভলিবল খেলতে নিয়ে যাবে, তাই স্কুল ছুটি। পরের দিন অনেক রাত করে ফিরল বেলো। বলল সে টিম লিডে ছিল। দারুণ খেলেছে। পরে জানা গিয়েছিল সে স্কুলের পাশের এক পাড়ার ছেলেদের সাথে পিকনিক করতে গিয়েছিল। সবচেয়ে আশ্চর্য্য হল বেলোকে এসবের জন্য অনুতপ্ত হতে কেউ কোনোদিন দেখেনি।
      এভাবেই বেলো বড় হতে লাগল। বাড়ির লোক ভাবল এবার শুধরে যাবে, এবার শুধরে যাবে। হল না। বরং যত বড় হতে লাগল তত মিথ্যার চরিত্র বদলাতে লাগল। ক্রমশ তা অন্যায় থেকে অপরাধের দিকে মোড় নিতে শুরু করল। বাড়ির লোক হাল ছাড়ল।
      বেলোর মধ্যে যেন দ্বৈতসত্তা। সে ভাবতেও পারে না সে আজ অবধি কোনো মিথ্যা কথা বলেছে বা তাতে কারোর কোনো ক্ষতি হয়েছে। সে মাস্টারের মায়ের মৃত্যু স্বচক্ষে দেখেছে, অবশ্য সকালে না, যখন মাকে বলছিল তখন। এমনকি তার চোখে জলও এসে গিয়েছিল। সে সেদিন ভলিবল খেলাটা পুরো দেখতে পেয়েছে যখন বাড়িতে এসে মাকে বলছিল। হ্যাঁ সেই তো ম্যান অফ দা ম্যাচ হয়েছিল! সে দেখতে পেয়েছে পুরো ঘটনাটা, যেমন করে মানুষ ঘটে যাওয়া ঘটনা মনের মধ্যে দেখতে পায়, পুরো সে ভাবেই।
        যখন সে কলেজে পড়ে তখন তার একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক হয়। মেয়েটাকে বেলো বলে তারা জমিদার ছিল, তার বাবা এখনো ঘোড়ায় চড়েন, তার মা লক্ষ্ণৌ এর বড় বড় উস্তাদদের কাছে গান শিখেছেন, তাদের বাড়িতে এখনো বাদশাহী মোহর আছে ইত্যাদি। বলা বাহুল্য এর একটাও বাস্তব না। কিন্ত বেলোর কাছে দিনের আলোর মত বাস্তব। সুদেষ্ণা জানতে পারল যখন প্রথমে সে খুব ভেঙে পড়েছিল। তবে সুদেষ্ণা অন্য ধাতুতে গড়া। নিজেকে সামলে সে বেলোকে বলেছে, চলো একজন ভালো সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাই।
- কেনো?
- কারণ তুমি সুস্থ নও। তুমি যে কথাগুলো আমায় বলেছ সেগুলো বাচ্চারা বলে বেলো! লক্ষীটি এখনো দেরী হয় নি। চলো প্লিজ!
- না না সুদেষ্ণা, আমি যেতে পারব না। আমি জানি আমি সব মিথ্যা বলেছি। কিন্তু কেন বলেছি জানি না। আমার যে কেনো এরকম একটা ঘোর হয়!
     মনে মনে বেলো যদিও ভেবেছে, কই আমি মিথ্যা বলেছি, এরকম কি হয় না? খুব হয়!
    তারপর কান্নাকাটি করে সুদেষ্ণাকে কোনোরকমে ভুলিয়ে আবার সে সব সামাল দেয়। কদিন পর আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। অবশেষে তাদের এ সম্পর্ক কলেজে শেষ হওয়ার দু'বছরের মধ্যেই ইতি হয়।

 

বর্তমান কথা
-------------
 
      এখন বেলো একটা ক্যাটারারের ব্যবসা চালায়। বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি। তার পরিচিতি অনেক। কিন্তু বন্ধু নেই বললেই চলে, শুধু স্কুলের কয়েকজন পুরোনো বন্ধু ছাড়া। ছোটবেলার বন্ধুত্বের একটা নিঃশর্ত টান থাকে। বেলোর ওপর কিছু বন্ধুর সেরকম একটা টান এখনো রয়ে গেছে। তাকে নিয়ে তারা আড়ালে হাসে। বেলো জানে সব। কিন্তু নিরুপায় সে।
    বিয়ে করেছে পাঁচ বছর হল। একটা ছেলেও আছে তিন বছরের, পাবলো। মৌমিতা মানে বেলোর স্ত্রী এখন কিছুটা আন্দাজ করেছে বেলোর স্বভাব। আগে ভাবত তার স্বামী অন্যদের চেয়ে একটু বেশি কল্পনাপ্রবণ এই যা কিন্তু মানুষটা আদতে ভাল। সে ভুল ভাঙতে বেশি দেরি হয় নি মৌমিতার। এখন বুঝেছে তার স্বামীর অতি-কল্পনা কতটা আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে তাকে মাঝে মাঝে। শান্তিতে সংসার করা দায় হয়! তবে বেলোর স্বভাবে কিছু একটা আছে। সে রাগতেও পারে যেমন তুচ্ছ কারণে, খুশীও হয়ে যায় অল্পেতেই। রেগে গেলে মুখের আগল থাকে না, আবার রাগ পড়লে পায়ে পড়তেও সময় নেয় না। কিন্তু আশ্চর্য ওই যে বললাম, সে ধরা পড়ে গেলেও অনুতপ্ত হয় না।
     মৌমিতা গ্রামের মেয়ে। বেশিদুর পড়াশোনা করেনি। সে এত সাঁত পাঁচ বুঝতে পারে না। খুব কষ্ট হলে কাঁদে লুকিয়ে লুকিয়ে। বেলোকে বলে কোনো লাভ নেই সে বুঝে গেছে। ওর স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে এটা এখন, মৌমিতা বুঝেছে।
     বেলোর কিন্তু মাঝে মাঝেই মনে হয় জীবনটাকে সে পুরো ধরতে পারল না। তার অনেক ইচ্ছা ছিল খুব নাম ডাক হবে, বিলাসবহুল জীবন হবে, কেউকেটা হয়ে ঘুরে বেড়াবে। তার কিছুই প্রায় হল না।
     সব যেন কেমন গুলিয়ে গেল। তার মনটা দিন দিন কেমন গিরগিটির মত রঙ পাল্টে ফেলছে। সে আগে জেনে বুঝে পাল্টাত। এখন সে ধরেতেও পারে না কখন পাল্টে যাচ্ছে সে। রাতে মৌমিতাকে দেখলে ভয় হয়, ছেড়ে চলে যাবে না তো! আবার কখনো কখনো মনে হয় কি দরকার ছিল মৌমিতার বা পাবলোর তার জীবনে।
   বেলো উঠে পায়চারী করে! জল খায়। আবার শুয়ে পড়ে। ঘুম আসে না। আবার উঠে এসে জানলার কাছে দাঁড়ায়। তারা ভরা আকাশটার দিকে তাকায়। আচমকা সুদেষ্ণার কান্না কান্না মুখটা মনে পড়ে। এত মানুষকে ঠকিয়েছে সে সারা জীবন! গলার কাছে কান্না জমাট বেঁধে আসে। ইচ্ছা করে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে। কিন্তু পারবে না। খুব লোভী আর ভীতু সে। লোভীরা খুব ভীতু হয় সে জানে। কেন যে তার এত লোভ! ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চায়। ভাবে কাল সে নতুন মানুষ হবে। ঠকাবে না আর কাউকে।
   সকাল হয়। মৌমিতা চা নিয়ে আসে। বেলো মৌমিতার হাতদুটো ধরে বলে, চলো আমরা তিনজন পুরী ঘুরে আসি সামনের মাসে।
    বেলোর ভিতর থেকে একজন বলে, মিথ্যা বলছ। বেলো তবু বলে।
    মৌমিতা মৃদু হেসে চলে যায়। স্বামীর এ রূপটাও পুরোনো তার কাছে। মৌমিতার আবার কান্না পাচ্ছে।


(ছবিঃ সুমন দাস)