Skip to main content
 
 
       আমি হতচ্ছাড়ার মত গঙ্গার ধারে বসে। রীতিমত বিরক্ত লাগছে। গা চিড়বিড় করছে। কারণ এখনও বিএসএনএল অফিসে লোক আসেনি। আমাদের ল্যাণ্ডফোনটা সারেণ্ডার করতে হবে। কাঁকিনাড়া গঙ্গার ধার। সোজা রাস্তা পিছন দিক দিয়ে আমার। গরমের দুপুর, গরুগুলোরও ঘাস খাওয়ার প্রবৃত্তি নেই আর। আরো একঘন্টা বসে থাকো। ঝিমুনি ধরে এসেছে। হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনে ঘুমে ঝাঁকুনি লাগল।
       একটা রোগা কালো ঢ্যাঙা মত লোক, ময়লা পাঞ্জাবি আর পায়জামা গায়ে আমার থেকে কিছুটা দূরে বসল। বাঁধানো ঘাট। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অবশ্যি আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন ভারতবাসী স্বচ্ছভারত শব্দবন্ধের সাথে পরিচিত নন।
       লোকটা গঙ্গার দিকে তাকিয়ে বসল। আমার দিকে একবার তাকালো। ভাবলেশহীন মুখ। তারপর 'জয় মা' বলে বাঁধানো মেঝেতে শুয়ে পড়ল। আকাশের দিকে খানিক তাকিয়েই ধড়মড় করে উঠে পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বিড়ি খাস!
       হতচ্ছাড়া, শুঁয়াপোকা, গণ্ডার, টিকটিকি... এক্কেবারে তুই তোকারি, না হয় কলেজের বেড়া টপকাইনি, কিন্তু গোঁফজোড়া কি চোখে পড়ে না... তায় আবার বিড়ি!
       বললুম 'না', তাকালাম না। টিনটিনের বইয়ের আরো কয়েকটা শ্রীনীরেনবাবু প্রসূত গালাগাল করে ভাবছি উঠব, কিন্তু যাবই বা কোথায়! আজ কাজটা মিটিয়েই যাব।
       সে বলল, বিড়ি খাস না, মদ খাস?
       আরে কে রে! এরপর তো জিগাবে গাঁজা খাস, খারাপ পাড়ায় যাস? কোনো উত্তর করলাম না।
       সে বলল, আমি সকালে ডিমভাত খেয়ে বেরিয়েচি। আমি মদ বিড়ি সিগারেট কিচ্ছু খাই না। লটারির টিকিট বিক্রী করি। আজ সকালেই দশকোটি টাকা বাধল, ছেড়ে দিলাম শালা... টাকা মাটি মাটি টাকা... ছেড়েই দিলাম... হুস.. উড়ে গেল টাকা.. ওই দেখ... তাকা তাকা... ভালো করে দেখ... ওই উড়ে যাচ্ছে.... সব আমার টাকা.. আমিই উড়িয়ে দিয়েছি... বেশ করেচি শালা... আমি কি টাকার বশ...
       তোর বিয়ে হয়েচে?
       না
       আমার হয়েচে.. মেয়ে আছে.. মেয়ে ডিম ছাড়ালো... বউ মেখে খাইয়ে দিল... এই অ্যাত্তোবড় কুসুম দেখ... আরে দ্যাখ ইদিকে দ্যাখ... এই এত্তবড়...
       যতবড় কুসুম দেখাচ্ছে অতবড় ডিম পেড়ে কোনো হাস বা মুরগী বেঁচে থাকতে পারে বলে আমার বিশ্বাস হয় না.. মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে আবার অপেক্ষা করছি কি বলে...
       এই... এই.. শোন... ডাকছে.. হাঁটছে.... পেটের মধ্যে হাঁটছে মুরগীটা.. কাদের মুরগীর ডিম বলতো? আরে আমার পিসিমার জায়ের বাড়ির… মহা খানকি মাগী.. তাদের মুরগী আর না হোক পঞ্চাশটা ডিম পাড়ে... একটাও দেবে? আজ আমি চুরি করে...
       একটা কাক এসে বসল লোকটা থেকে কিছুটা দূরে। লোকটা পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে বলল, হুস! আমি কাকের ডিম খাই কে বলল?
       তুই কি খেয়ে বেরিয়েচিস?
       বললাম, রুটি তরকারি। কেন বললাম জানি না। না বললেও হত। কিন্তু যা করলেও হত তা করতে গিয়েও কি সব সময় করা হয়? হয় না তো। এখনও তাই বলব না বলেও বলেই ফেললাম।
       সে আমার হাতের ব্যাগ দেখিয়ে বলল, কি আছে?
       বললাম টেলিফোনের কাগজ। লোকটা শুনলনা। হুড়মুড় করে জলে নেমে গেল। নামতে নামতেই পায়জামা পাঞ্জাবি সিঁড়িতে খুলতে খুলতে গেল, পরনে একটা চেক চেক হাফপ্যান্ট, তাও হাজার জায়গায় ছেঁড়া...
       জলে বেশ কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে উঠে এলো। ভিজে গায়েই পায়জামা পাঞ্জাবি পরতে পরতে বলল, ভাত খাওয়াবি? চান করে উঠলেই আমার খিদে লাগে। আমি তাই বাড়িতে বাথরুম করিনি। ভাত নেই তো। আজ সকালেই বউ মেয়ে মরে গেল। জল না খেয়ে। আমি বাড়িতে জল রাখি না। গঙ্গায় এত জল তো! কিরে ভাত খাওয়াবি?
 
       দুপুর আড়াইটে। এখন কি হোটেল খোলা পাব? কি জানি। অফিসের ভদ্রলোক তিনটেতে যেতে বলেছেন। অগত্যা ওকে বললাম, আসুন দেখি হোটেল পাই কিনা। একটা হোটেল খোলা। ওকে ঢুকতে দেখেই দোকানের ভিতর থেকে একটা মোটা বউ বেরিয়ে এসে বলল, আবার বেরিয়েছিস তুই? আবার ওকে বিরক্ত করেছিস?
       লোকটা বেমালুম বলে উঠল, আরে উনিই তো খিদে পেয়েচে বলল, তা আমি বললুম, আমার দিদির হোটেল আছে, চিন্তা কি? চলুন। তাই...
       মহিলা দোকানের একটা ছেলেকে দিয়ে ওকে কোথাও একটা পাঠিয়ে দিলেন। আমি কি করব বুঝতে না পেরে বেরোতে যাচ্ছি, ভদ্রমহিলা এসে বললেন, আমার ভাই... ওর বউটা আর মেয়েটা একই সাথে জলে ডুবে মারা গেছে.. তারপর থেকেই মাথাটা.. আপনার থেকে কি কিছু পয়সা নিয়েছে?
       আমি বললাম, না না একদম না...
       ভদ্রমহিলার চোখটা ভিজে এলো.. কদিন আগেই তো মার খেয়ে মুখ চোখ ফুলিয়ে.... আচ্ছা আপনি আসুন.., এসব শুনে কি করবেন.. আমারই পোড়া কপাল....
       আমার কেমন কৌতুহল হল। বললাম, ওনার কি লটারির ব্যবসা ছিল?
       উনি ভুরু কুঁচকে বললেন, না তো... ডিমের... আমিই দেখি ওর ব্যবসাটা এখন.. কেন বলুন তো...
       বললাম, না, এমনি....
       ভদ্রমহিলা বললেন, এদিকে এলে ডিমভাত খেয়ে যাবেন না হয়.. গরীবের হোটেল.. পয়সা নেব না.. পাগল ছাগল যাই হোক, ভাই তো... সে যখন সাথে করে নিয়ে এসেচে...
আমার ধড়াস করে কান্না পেল... মহাপুরুষের আকাশকুসুম বাণী সহ্য হয়.. কিন্তু এসব অলুক্ষুণে ভালোবাসা দেখলে গাপিত্তি জ্বলে যায়.... চোখ টাটায়.. নাক টাটায়.. কোনোরকমে মুখ ঘুরিয়ে পা বাড়ালাম... আসছিটুকুও বললাম না... গলার আওয়াজকে বিশ্বাস হল না...