নিরাকার থেকে সাকার, আদিদেব থেকে ইদানীং লোকনাথ বাবা --- কার না ক্যালেণ্ডার, ছবি নেই এ দেওয়াল, সে দেওয়াল, আলমারীর গায়ে, খাওয়ার টেবিলের পাশে ইত্যাদি ইত্যাদি। পরেশের মজাও লাগে, রাগও লাগে। ইলাকে কিছু বলে না। তাদের মেয়ে জয়িতা এবার মাধ্যমিক দেবে, তার সাথে মাঝে মাঝে ইলার ঝামেলা লেগে যায়। এই আচার-বিচার নিয়েই। এঁটোকাঁটা, নিরামিষ-আমিষ ইত্যাদি এটা সেটা নিয়ে ঝামেলা লেগেই আছে। পরেশ মাথা ঘামায় না আর, আগে বোঝাবার চেষ্টা করেছে, ইদানীং আর করে না।
এবারের সমস্যাটা গুরুতর। শুরু হয়েছে মাসখানেক হল। তাদের যৌথ পরিবার ছিল, মানে এখনও আছে, কিন্তু সদ্য লক্ষ্মীদেবী মারা যাওয়ার পর চার হাঁড়ি আলাদা হয়েছে। আগে শাশুড়ির ঠাকুরঘরেই চার বউ পূজো আচ্চা করত, কিন্তু সেটা গেছে বড় বউয়ের জিম্মায়। তাই ইলা, মানে বাড়ির সেজো বউয়ের দাবী হয়েছে তাকে ঠাকুরঘর বানিয়ে দিতে হবে। পরেশ মোটামুটি ভালোই চাকরি করে। ঠাকুরঘরও বানিয়ে দেওয়াই যায়। কিন্তু এক, মেয়েটা মাধ্যমিক দেবে, তারপর আরো পড়াশোনার খরচ বাড়বে, তাছাড়া ঠাকুরঘর বানাবার জায়গাই বা কোথায়? যে এক চিলতে মাটি পেয়েছে তাদের ঘরের সামনে সেখানে শীতকালে পরেশ বসে বই পড়ে, এটা তার ছোটোবেলার অভ্যাস। সে তাই এইটুকু জমি ছাড়তেই চায় না। ইলার বইয়ের নেশা নেই। কিছুই পড়ে না। প্রথম প্রথম পরেশ নানা ধরণের বই এনে দেখেছে, ওর কিছুতেই মন বসে না। শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে।
ইলা কথা বলে না। বাপ মেয়েতে এই নিয়ে প্রথম প্রথম কয়েকদিন ঠাট্টা করলেও, দেখেছে খুব একটা সুরে বাজেনি ইলা। এখন দু'জনেই এই প্রসঙ্গটা সযত্নে এড়িয়ে যায়।
পরেশ একদিন অফিস থেকে ফিরে এসে দেখে ইলা বাপের বাড়ি চলে গেছে। বাপের বাড়ি সোদপুর। চাকদা থেকে দূর নয়, আবার খুব কাছেও তো নয়ই। জয়িতা একটা খামে ভরা কাগজ পরেশের হাতে দিল। খামটা আঠা দিয়ে সিল করা। পরেশ জানে ওতে কি লেখা আছে। খুলল না। পরে পড়বে। বড়বৌদি এসে বলে গেল যদ্দিন না ইলা আসছে ততদিন যেন বাপ-মেয়ে তার কাছে খেয়ে নেয়। পরেশ মনে মনে পরের দিনই একটা রান্নার লোক রাখবে ঠিক করল।
পরের দিন অফিসে ফোন এলো সোদপুর থেকে। ইলার ধুম জ্বর। পরেশ হাফ ছুটি নিয়ে সোদপুর গেল। একটা গাড়ি ঠিক করে ভাবল ইলাকে নিয়ে চলে আসে, শ্বশুরমশায় বাধা দিলেন। পরেশ শেষ ট্রেনে বাড়ি ফিরল। জয়িতা আছে, নইলে থেকেই যেত, সামনে টেস্ট ওর পূজোটা শেষ হলেই। আর ক'টা দিনই বা বাকি।
ইলা পাঁচদিনের জ্বরে মহালয়ার দিন ভোরে মারা গেল। ডেঙ্গু হয়েছিল। ছাদে প্যাণ্ডেল করে শ্রাদ্ধ হল। সামনের এক চিলতে জমিটুকুতে বসে একজন পুরুত গীতা পড়ল। এই প্রথম পুরো গীতাটা শুনল পরেশ। বুঝল না। ভিতরে ভিতরে কাঁদল। অশৌচ কাটার পর জমিতে ভিত হল। মন্দির উঠল। মহাদেব প্রতিষ্ঠিত হলেন। পরেশই দুইবেলা পূজো করে। জয়িতা শনিবার আর বৃহস্পতিবার নিরামিষ রান্নার কথা রান্নার দিদিকে বলে দিয়েছে। বড়বৌ এসব মানত না আগে। কিন্তু মেয়েটা নিরামিষ খায় সে কি করে মাছ মুখে তোলে, সে নিজেও বৃহস্পতিবার আর শনিবার নিরামিষ রাঁধে এখন। খাবার গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে, কি হত ঠাকুরঘরটা সেজোকে দিয়ে দিলে? কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে?
পরেশ তারাশঙ্করের ছোটোগল্পের দ্বিতীয় খণ্ডের মধ্যে একটা খাম পেল। ইলার লেখা সেই না খোলা চিঠিটা।
“আমি বাপের বাড়ি চললাম। কোনোদিন বেশি কিছু চাইনি। আজ যা চেয়েছিলাম তা তোমার আর মেয়েটার মঙ্গলের জন্যেই। বুঝলে না। আমি যেদিন মরব সেদিন বুঝবে আমি কি করতাম, কেন করতাম। সুস্থ থেকো। জয়িতার ঠাণ্ডার বাতিক। দেখে রেখো। আমি মায়ের সাথে কাশী যাব। মন শান্ত করে ফিরে আসব। ও হ্যাঁ দীক্ষা নেব ঠিক করেছি, তুমি ভেবে দেখো। স্বামী স্ত্রী একসাথে নেওয়াই প্রথা। ইলা”
পরেশ চিঠিটা সারারাত বহুবার পড়ল। নিজেকে অপরাধী মনে হওয়াটা হয় না, একটা কাঠচেরা ব্যাথ্যা হয় বুকের মাঝখানটায়। দমবন্ধ লাগে। একা থাকা মানে বুঝতে শুরু করেছে। মাঝসমুদ্রে একা ভেলায়। কোনদিকে যেতে হবে? তীরের জন্য যে কান্না আকাশ কি বোঝে?
ভোর হচ্ছে। মন্দিরের চূড়ায় একটা দোয়েল বসে। পরেশ দোয়েলটাকে দেখতে দেখতে বুঝল তার মন সোদপুরের বসার ঘরে বসে, দীক্ষা নেবে, শাশুড়ির সাথে কথা বলছে। পরেশ উঠে বাথরুমে গেল, জয়িতাকে জাগিয়ে বলে গেল "ওঠ, সোদপুর যাব, আর না খেয়েই বেরোব আমরা।"