গ্রামের পাশে সেই নদী
১
--
ক’দিনের জন্য হাপিশ হলাম। ধূপগুড়ি। যাওয়ার ইচ্ছা তো ষোল আনা, কিন্তু যাই কি করে? পায়ে তো আর ভূতের রাজার জুতোজোড়া নেই! রেলই ভরসা। কিন্তু যেই না নেট অন্ করে আসন সংরক্ষণের তালিকা খোঁজা, আমনি রেল হাউমাউ করে বলে উঠছে, ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো এ তরী, বড়দিন যাত্রীতে গিয়েছে ভরি’। তো কথা হল ব্রেক জার্নি করে যাওয়া হবে। যেই কথা সেই কাজ। ফের খোঁজ খোঁজ, খণ্ড যাত্রাপথে কে দেয় বসিবারে ঠাঁই? পাওয়া গেল। রাধিকাপুর এক্সপ্রেসে বারসৈ অবধি কয়েক খান সিট আছে। তারপর ঠিক হল ইন্টারসিটিতে করে শিলিগুড়ি, বাকি যাত্রাপথ বাসে আর ম্যাজিক ট্যাক্সিতে হয়ে যাবে।
বাইশে ডিসেম্বর রাত। নৈহাটি থেকে চেপে বসা গেল। সেদিন তো মেলা ঠাণ্ডা ট্রেনে। যা হোক ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ এসে পৌঁছালাম বারসৈ। তখনও সুয্যি বাবাজির দেখা নাই। প্রকৃতি কম্বল মুড়ি দিয়ে গভীর ঘুমে। কিছু মানুষ সারা পৃথিবী জুড়ে আছে না, যারা সূর্য ওঠার আগেই ওঠে আর সূর্য পৃথিবীর অপর গোলার্ধে যখন তখনও কাজ করে চলে, কাজ করে মানে বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করার যুদ্ধে নামে। ছিনিয়ে নিতে নেই বলে, নিজের শরীরের শেষ রক্ত অবধি লড়ে ‘ছোটোলোক’ হয়ে বেঁচে থাকে। তাদের সংখ্যাই বেশি আমাদের চারপাশে তখন। ও, আমাদের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ল, আমরা ছ’জন মিলে রওনা দিয়েছি, গন্তব্য আমাদের এক বন্ধু, দেবাশিষের মামাবাড়ি।
ক্রমে আলো ফুটল। ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস কাটিহার ছেড়ে আসছে। ধীরে ধীরে স্টেশানে লোকসংখ্যা বাড়ছে। ছাত্র-শিক্ষক-চাকুরে-ব্যবসায়ীদের ভিড় বাড়ছে। আমাদের চেয়ার কারে রিজারভেশান। অপেক্ষায় আছি। এমন সময় হুসহুস করে ডিজেল চালিত খান কয়েক বগি নিয়ে বিষ্ঠাসঙ্কুল লৌহপথে এসে দাঁড়ালো তৈলচালিত যান।
খাইসে, সে রিজার্ভেশান বগিগুলান কই? সামনের দিকেই তো থাকার কথা! লট-বহর নিয়ে ছোট ছোট... সেই বগিগুলোর দেখা মিলল এক্কেবারে শেষের দিকে। COACH No. D1। উঠে তো চক্ষু ছানাবড়া। থিকথিক করছে লোক। আমাদের বসার যায়গায় গিয়ে দেখলাম, বেশ কিছু মুসলিম চাচা বসে। বললাম, আজ্ঞে ওঠেন কত্তাচাচারা, বসুম। এ যে আমাদের রিজার্ভ করা।
যেই না বলা, অমনি কারোর মুখে কৌতুক, কারোর মুখে বিস্ময়। কারোর মুখে ঈষৎ ক্রোধ তো কেউ কেউ পুরো ভেবলে। তাদের মধ্যে একজন নেতা গোছের লোক বললেন, ‘এই ট্রেনে রিজার্ভেশান হয় নাকি?’
বোঝো, কি মোক্ষম প্রশ্ন। তবে একটা খটকা লাগল। চারদিকে ভালো করে চেয়ে দেখলুম, তাই তো। এদের কারোরই কাছে রিজার্ভেশান সংক্রান্ত কোনো কাগজ আছে বলে তো বোধ হল না। সে বোধ ঘটনায় প্রমাণিত হল চেকার আসার পর। তিনি বিন্দুমাত্র বিস্ময় প্রকাশ না করে আমাদের রিজার্ভেশানের টিকিটের দিকে করুন আঁখিপাত করলেন। বসার যায়গা অবিশ্যি আগেই পেয়েছি, তেনারাই কৃপাপরবশ হয়ে হয়ত বা, কিম্বা আমাদের মতন অদ্ভুত রিজার্ভেশান করে ট্রেনে চড়া জীব দেখবেন বলে যায়গা দিয়ে দিলেন। তারপর শুরু হল ‘তশরিফ’ যুদ্ধ। এ কিঞ্চিৎ অসাবধান হয় তো আরেকের তশরিফের দখলদারি এসে পড়ে। ট্রেন অবিশ্যি এ সবে উদাসীন। সে বড় দায়িত্ব পালনে রত। এক পেট লোককে যথাস্থানে পৌঁছানো কি চাট্টিখানি কথা বাপু!
আমাদের সহযাত্রীরা প্রায় কেউই জানলা খুলে পানের পিক ফেলার কষ্ট করছেন না। উঠে গিয়ে ট্রেনের ভিতরেই সেরে আসছেন। অগত্যা সহজেই অনুমেয় শৌচালয়ের ভিতরের কি অবস্থা হতে পারে। আমরা চা-কফি কোনোদিকে দৃকপাত করছি না। কারণ সহজেই অনুমেয়। এই সকালেও পেটের মধ্যে যে আপাত সাম্যাবস্থা বজায় আছে তাকে উৎপীড়ন করে ঝোঁপস্থ বাঁশকে ঝোঁপে রাখাই শ্রেয় মনে করলাম আমরা।
আজব ট্রেন। বেশিরভাগ স্টেশানেরই কোনো প্ল্যাটফর্ম নামক বস্তু নেই। ধরিত্রী যে তল দিয়েছেন তারই উপর দাঁড়িয়ে মইয়ের মত রেল কোম্পানী নির্মিত সিঁড়ি বেয়ে এই যানে ওঠাই বিধি। সবাই তাই উঠছে। যে স্টেশানের গপ্পো না বললেই নয়, সে হল, কানকি।
স্টেশানেই বেশ বড় সব্জী বাজার। সাথে লুঙ্গী, শাড়ি ইত্যাদিও আছে। তারা অবশ্য সিলেবাস বহির্ভূত। বেচাকেনা চলছে। আমাদের কিছু সহযাত্রীও নেমে কিনতে গেলেন। হঠাৎ শুনি কে একজন বগির ওদিক থেকে রামনাম গাইছেন আর ভিক্ষা চাইছেন। শুনে কেমন খটকা লাগল। বগির নিরানব্বই শতাংশ তো মুসলমান, ভিক্ষুক কি জানেন না? চক্ষুদ্বয় আরো ভিরমি খেলো ভিখারিকে চাক্ষুষ করার পর। তিনি নিজেও মুসলিম। পরনে চিরপরিচিত বস্ত্র। সাদা দাড়িতে মেহেন্দি করা। তিনি আল্লাহ নামও গাইছেন, রাম নামও। এটাই ভারত না হলেও, এটাও ভারত। যত তাড়াতাড়ি বুঝি ততই মঙ্গল।
হঠাৎ শুনি বেজায় চেঁচামেচি। বাজারে হইচই। মারামারি। এ দল, ও দল। দু পক্ষেই নারী-পুরুষ মায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অবধি। কারণ জানা যাচ্ছিল না, কিন্তু কার্যটি বেশ প্রত্যক্ষ হচ্ছিল। এ ওকে ঠেলে লাইনের ওদিকে নিতে চায়, তো অন্যপক্ষ তেড়েমেড়ে ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব একটাও ফুলকপি’ টাইপের রণং মূর্তি ধারণ করে। ও বাবা, এ যে পুরো হযবরল। খানিক বাদেই ট্রেন এলো ওই লাইনে। ইরেজারের মতন সব হাপিশ করে নিয়ে চলে গেল। বাদী-বিবাদী কেউ নেই। শুধু কুয়াশা ঘেরা। রোদছুটির সকাল একটা। একটা দৃশ্যে চোখ আটকালো। এক্কেবারে ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে, একটা বসার জায়গায় নিভৃতে এক পুরুষ আর এক নারী। দুজনেই বিক্রেতা হয়ত। কিন্তু দেহ ভঙ্গীমায় যেন অন্য কথা। ভালোবাসলে শরীরের ভঙ্গীমা বদলায়। পশুতেও টের পায় আর মানুষের কথা তো আর কি বলা। কি বলছেন ওনারা জানি না। তবে একটা গল্পের কয়েকটা উড়োপাতার মত এমন একটা সকালে বিভোর করে দিয়ে গেল, আমার চারপাশে সব বদলে গেল। ভালোবাসা চোখের রেটিনার কোষও বদলে দেয় নাকি? এত রঙ ছিল চোখে পড়েনি তো খানিক আগেও! ট্রেন ঢুকল শিলিগুড়ি।
২
---
ইহা কি বাস? শিলিগুড়ি থেকে ধুপগুড়ি নিয়ে যাবে। বাতানুকূল। কিন্তু হে হরি, এ যে লরির উপর বাসের কাঠামো! যা হোক। পাঁইপাঁই করে ছুটতে শুরু করল। আপনারা যারা নারায়ণবাবুর ‘ভালোয় ভালোয়’ পড়েছেন তারা সহজেই অনুমান করতে পারবেন পানকেষ্টর গাড়ির বর্ণনা। এটিও তার চাইতে কোনো অংশে কম নয়। সিটের সাথে নিজেকে স্থির রাখা রীতিমত যুদ্ধ। এক ঢোক জল গিলতে গেলে আগে দেখে নিতে হচ্ছে সামনের রাস্তায় কেউ ওভারটেকযোগ্য আছেন কি? কিম্বা কোনো গহ্বর? হঠাৎ একটা দোকানের সাইনবোর্ডে দেখলাম ধুপগুড়ি লেখা। অমনি শরীরের সব ক্লান্তি ভুলে সোল্লাসে চীৎকার করে বললুম, এসে গেছে... এসে গেছে... কণ্ডাকক্টার মহাশয় সে আশার অঙ্কুর নির্দয়ভাবে পায়ে দলিত করে যা ঘোষণা করলেন, তার মোদ্দাকথা, ‘ইহা সুত্রপাত মাত্র।’ গন্তব্যের ঢের দেরি। যা হোক, পাংশুমুখে বসে সহযাত্রীর বালির লরির ড্রাইভারের সাথে ফোনে বাদ-বিতণ্ডা শুনছি। মাঝে মাঝেই ফোন কেটে যাচ্ছে চলন্ত বাসে। তারপরেই ওনার ফোন বেজে উঠছে – ‘জয় রাম, সাঁই রাম ... সাঁই ভগবান’... ফোন ধরেই ফের উদোম খিস্তি।
হঠাৎ কণ্ডাক্টারের খুব বিনম্র প্রশ্ন, আপনারা ধুপগুড়ির কোথায় নামবেন? আমার বন্ধুর দিকে আঙুল তুলে দেখালাম। সে বলল, বাসস্ট্যাণ্ড। বাস দাঁড়ালো। আমরা গড়ানে বস্তার মত নামলাম। পাশেই বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ। কালী মন্দির। ভাবলাম গিয়ে বসি একটু। বন্ধুরা ম্যাজিক ডাকতে গেছে। এখন আমাদের গন্তব্য হবে নাথুয়া। বসতেই বুঝলাম এটা আসলে শ্মশান। একেই ক্লান্তিতে শরীরে-মনে অবসাদ, তায় শ্মশানের বৈরাগ্য মনটাকে প্রায় গেরুয়ায় ছুপিয়েই তুলেছিল, বাধ সাধল এক নাম না জানা পক্ষীর সাদা বিশুদ্ধ বিষ্ঠা। পক্ষীর হাগু কি বিষ্ঠা? জানি না। সে তর্কে মন গেল না। একটা বট পাতা জোগাড় করে সে কলঙ্কমুক্ত হয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ম্যাজিক ট্যাক্সি এলো। আদ্যোপান্ত ধুলো উড়িয়ে শুরু হল অন্তিম যাত্রা, ইয়ে মানে গন্তব্যাভিমুখী শেষ যানারোহণ।
গাড়ি যত গ্রামের ভিতরে ঢুকতে লাগল মন তত প্রসন্ন হতে শুরু করল। চারদিকে চা বাগান। ফুলের গন্ধ, চারপাশে ফাঁকা ফাঁকা মাঠ, অস্তগামী সূর্যের ছড়িয়ে যাওয়া শেষ আলোটুকু মুছে নেওয়া গোধূলি। গাড়ি এসে দাঁড়ালো গন্তব্যে। দেবাশিষের মামাবাড়ি। আমরা অতিথি। শহুরে, কলকাতা ঘেঁষা, আধুনিক সাম্রাজ্যের বাসিন্দা।
ঘর নয়, নীড়। স্বর্গীয় শান্তির অনুভব।
৩
---
চারদিকে চা-বাগান ঘেরা একটা গ্রাম। টিনের বাড়ি বেশিরভাগই। বড় বড় জানলা। খুললেই চারদিকে বড়বড় গাছ। পরিষ্কার পরিপাটি করে গোছানো একটা ঘরে এসে ঢুকলাম। পাকা মেঝে। সামনে একটা উঠান। পাশে গোয়াল ঘর। উঠানের একপ্রান্তে চাপাকল। তার পাশে স্নানাগার, শৌচালয়। উঠানের সামনে বড় একটা রান্নাঘর। তার বাঁদিকে দুটো ঘর। আমরা যেখানে উঠলাম সেটাও দুটো বড়বড় ঘর। সামনে একফালি বারান্দা।
ঠাণ্ডা যেমন ভেবেছিলাম তেমন নেই। বসার খানিক পরেই এলেন দেবাশিষের দিদিমা। বুদ্ধিদীপ্ত এক উজ্ব্বল মুখ। গল্প শুরু হল। ওনার দুই ছেলেই আমার থেকে ছোটো। একজন পোস্টাফিসে কাজ করেন, আরেকজন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন। আরেকজন মেয়ে অবিবাহিতা। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।
যত কথা এগোতে লাগল, তত একটা ফেলে আসা জীবনের কিছু কিছু মুহূর্তের সাক্ষী হতে শুরু করলাম। তিনি কোথাও যাননি। খুব আশ্চর্য লাগল। দার্জিলিং, কালিম্পং, ডুয়ার্স ইত্যাদি এত নানান জায়গার এত কাছে থেকেও কোত্থাও যাননি? এ যেন মহতী বিনষ্টি আমাদের কাছে। আমার বিস্ময়ে ওনার হাসি পেল। উনি বললেন, ‘বাবা আমার গোয়াল দেখনি? গোরু পুষলে গোরু হতে হয়, ছাগল পুষলে পাগল। আমার ওদের জন্য কোথাও যাওয়ার মন হয় না। বহুকাল আগে একবার তোমাদের দেশে হালিশহরে গিয়েছিলাম। তোমরা যেমন ট্রেনে যাতায়াত করো, আমার তেমন প্রিয় বাস। সেই কলকাতাতে থেকে উঠে সোজা ধুপগুড়ি এসে নামো।’
তারপর কথা গড়ালো... ওনার স্বামীর কথা, বাংলাদেশ ছেড়ে এ দেশে এসে মাটির লড়াই। নিজেদের আবার শূন্য থেকে মাথা উঁচু করে বাঁচার লড়াইয়ের গল্প। যে মানুষটার হাত ধরে এ দেশে আসা তার ইহলোক ছেড়ে যাওয়ার কথা। বললেন, ‘এই যে কারেন্ট দেখছ, মাঝে পঁচিশটা বছর ছিল না। তার চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। অফিসের লোকেরা বলল, অপেক্ষা করতে হবে। অনেক কাগজ-কলম হয়ে আবার তার আসবে। সে অপেক্ষা করতে করতে পঁচিশটা বছর কেটে গেল। ওদের বাবাও চলে গেলেন অন্ধকার ঘরেই। কারেন্ট আর দেখে যেতে পারলেন না। সবই ভাগ্য বাবা। আমি তাই মেনে নিয়েছি। ভাগ্যের উপর তো কথা চলে না। এই যে তোমার মা এত অল্পবয়সে চলে গেলেন, তুমি মা হারা হলে, এ নিয়ে কার কাছে অভিযোগ করবে বাবা? এ তো ভাগ্য, ভাগ্যের সাথে তো লড়াই চলে না। মেনে নিতে হয়। যতদিন যে যার কপালে সঙ্গে থাকে। আর যার মা নেই তার তো জগতে কিছুই নেই বাবা। মায়ের কোনো বিকল্প হয়?’
বাইরে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। শব্দ বলতে ওইটুকুই। ওই নিঃশব্দতার মধ্যে বৃদ্ধা রমণীর কথাগুলো যেন কোন চিরকালের চেনা ভারতবর্ষের রূপ ধরে সামনে এসে দাঁড়ালো। মনে হল এই তো আসল রূপ আমার বাংলার, বাকিটা তো সাজ। সাজ কি আর চিরকালের, সে তো চোখ ধাঁধানোর।
রাত গভীর হল। খাওয়ার আয়োজন হল। সে প্রসঙ্গ থাক। ভোজন রসিক আমি কোনোদিন নই। তবু ওই রকম আত্মীয়তা, আদর আন্তরিকতার স্পর্শ জীবনে কতবার পেয়েছি? মনে পড়ে না। সেই মেয়েটার ‘দাদা’ বলে আমায় ডাকা, আমার বন্ধুদের ‘ভাইগেনা’ বলে কত স্নেহ নিয়ে ডাকা। মানুষের এই গলার আওয়াজটা বড্ড অপরিচিত এখনকার শহুরে সভ্যতায়। আমাদের যে পদে পদে প্রমাণ দিতে হয়, যোগ্যতার হিসাবনিকাশ মেটাতে হয়, সর্বোপরি এর-ওর-তার ‘মত’ হয়ে একটা বিরাট মানুষ হওয়ার দায় তো আছেই।
অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে তাই ভাবছিলাম। আমি এদের কে? যারা আমার চারপাশে শুয়ে, মানে যাদের আমি আমার বন্ধু বলে পরিচয় দিচ্ছি, তারা তো আমার থেকে কত বছরের ছোটো, আমার ছাত্র ছিল এককালে। আমি কথায় কথায় জেঠিমাকে (দেবাশিষের দিদিমা) বলেছিলাম, ‘আমায় ‘আপনি’ বলবেন না।’ উনি বললেন, ‘সেকি, আপনি ছিলেন ওর মাষ্টার, যাকে যার সম্মান তা তো দিতে হয়!’
আমার ঘুম আসছে না। শুনেছি বাড়ির থেকে কয়েক পা গেলেই নাকি নদী। মনে মনে ভাবছি কেমন সে নদী? তবু বারবার ফিরে ফিরে আসছে একটাই কথা, এই যে পরিচিত হতে পারা, এই যে একটা মানুষের কাছে একজন মানুষের মানুষ হিসাবেই মূল্যবান হওয়া, এ কি কম বড় কথা? এ কি কম সভ্যতার কথা? মানুষ মানে কি? তার ক্ষমতা, না তার অনুভব আর চিন্তা? কবীরের সেই কথাটা মনে হল, সব সে বঢ়া সচ্ ওহি হ্যায়, জো দিল সাচা হোয়ে... সবচাইতে বড় সত্য সেই, যে হৃদয় সত্য সে-ই।
৪
---
সকাল হল। নদীতে স্নানে যেতে হবে। হইহই করে চললাম নদীতে সব। সাথে দেবাশিষের বড় মামা, হরি। নদীটা দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। যেন একটা বাচ্চা খেলতে খেলতে তুলির একটা টানে নদীটা এঁকেছে। একটা বাঁক, তার পরে আরেকটা বাঁক, সাপের মত এঁকেবেঁকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে সামনে। তার একধারে গ্রামের রাস্তা, আরেক ধারে জঙ্গল। নদীর গভীরতা হাঁটু অবধি। কিন্ত কি তার স্রোত! কি তার স্বচ্ছতা। দাঁড়ালে নিজের পায়ের পাতা, নুড়ি, ছোটো ছোটো মাছ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একটু দূরেই দেখলাম শ্মশান। একটা ছাতা ঢাকা হবিষ্যির পাত্র। কার জন্য এমন আমন্ত্রণ? যিনি দেখা-শোনার জগত ছেড়ে গেছেন, তিনি যেন এই নদীর ধারে ওই ছাতার তলায় বাবু হয়ে বসবেন আহারে। তার সেই স্বজনের হাতের রান্নার স্বাদ নিতে তিনি যখন ফিরবেন, তখন যেন এই তপ্ত রোদের জ্বালা তার অশরীরী শরীরকেও না ছোঁয় তার জন্য রইল ছাতা খোলা। কল্পনা? হলেও ক্ষতি কি? জীবনের রূঢ় বাস্তবের সামনে একটা কল্পনার মরুদ্যান না থাকলে মানুষ বাঁচে কি নিয়ে? এই কল্পনার আড়ালটুকু আছে বলেই না কত সংসারে ভালোবাসা এখনও আটপৌরে হয়ে বেঁচেবর্তে আছে। নইলে কবে সে তত্ত্ব হয়ে লাইব্রেরীর শূন্য কক্ষে পোকায় কাটা অস্তিত্ব সংকটে জীবন কাটাতো।
স্নান হল। হুল্লোড় হল। এবার বেড়াতে যেতে হবে। তিনটে বাইকে আটজন। সাথে যাবে হরির বন্ধু, এখানকার প্রাইমারী স্কুলের হেডমাষ্টার রাজেশ। একটা বাইকে দু’জন, বাকি দুটোতে তিনজন তিনজন করে। এভাবে যাত্রা অবশ্যই বিধিসম্মত নয়। তাই রাজপথ ছেড়ে চলা হল সরুপথে। পুলিশ এড়িয়ে। গন্তব্য সঠিক আমি জানি না। শুনেছি কোনো একটা জঙ্গল। আমার মন তো চারপাশের প্রকৃতিতে আর মানুষে। ওই গাছের ফাঁকে পোস্ট অফিস, রাস্তার মেরামতির শ্রমিকের দল, চা বাগানের পিঠে বোঝা মহিলারা, ম্যানেজারের বিলাসবহুল বাংলো --- একে একে পেরিয়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছি জেনে আর কি হবে? চেনা ছকের বাইরে এসেছি। যাই দেখি তাই নতুন। সে যেমনই হোক।
আমরা থামলাম এসে প্রকাণ্ড এক নদীর পাড়ে। বিশাল তার বপু। কিন্তু জল নেই তেমন। মানে প্লাবিত হওয়া জল নাই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিরা-উপশিরা হওয়া নদীর স্রোত ছড়িয়ে ছিটিয়ে। চারদিকে শুধু পাথর আর বালি... পাথর আর বালি। বড় বড় লরিতে চলছে পাথর আর বালি ভরার কাজ। কতটা আইনী আর কতটা বে-আইনী সে প্রশ্ন উঁকি দিল মনে। যা উত্তর পেলাম তাতে বুঝলাম লরিতেই শুধু বালি উঠছে না, বালি বহুদূর গড়াচ্ছে। পুরো কেসটাই বালি বালি। যাকগে সেসব কথা। আমাদের কিছুটা হেঁটে, কিছুটা বাইকে, কিছুটা জুতো-মোজা খুলে জল পেরিয়ে নদী পার হতেই লাগল প্রায় আধঘন্টার বেশি। বেজায় মজা হল। নদীর মধ্যে বাইকে চড়ার অভিজ্ঞতা প্রথম। চালকও পা তুলে জুতো বাঁচাচ্ছে, পিছনে আরোহীরাও। সব ঊর্দ্ধপদ হয়ে নদী পার হলাম। তারপর কাঁচাপাকা রাস্তা দিয়ে এলাম একটা ব্রীজের উপর। নীচে নদী। উপরে বেশ চওড়া ব্রীজ।
‘কলকাতা থেকে?’
একজন মধ্যবয়েসী, স্থূলকায় মানুষ। সাইকেলের উপর বসে একটা পা ব্রীজের ফুটপাথের উপর রেখে হেলান দিয়ে আমায় প্রশ্নটা করলেন। সাইকেলের সামনে কাঠের একটা চৌকো বড় বাক্স, সামনেটা কাঁচের। তার মধ্যে মেয়েদের নানা গয়নাগাটি। সাইকেলের পিছনে দুটো পোটলা, বুঝলাম তাতেও ওইরকম কিছু বস্তুই আছে। বললাম, ‘হ্যাঁ, ওই কাছাকাছি।’
তিনি বড়বড় চোখ করে বললেন, ‘গণদেবতার সাথে ভেঁট হইয়াছে?’
কথায় বিহারী হিন্দীর টান। বললাম, ‘আপনি কি বিহারের?’ উনি চমৎকৃত হয়ে বললেন, ‘হাঁ তো, আপনি ভি?’
বললাম, ‘না।’ তবে গণদেবতাটা কি? উনি নিশ্চই তারাশঙ্করের কথা বা গণদেবতা এক্সপ্রেসের কথা বলছেন না। তারপর হাতের ইঙ্গিতে বুঝলাম হাতির কথা বলছেন।
বললাম, ‘না সে সৌভাগ্য হয়নি।’
‘সৌভাইগ্য? কি বলেন? সামনে এসে দাঁড়াইলে আপনার ঝাড়া আর পসাব দুই বেরিয়ে যাবে। কোথায় উঠিয়েছেন?’
বললাম।
বললেন, ‘সে তো অনেক দূর, বাইকে এসেছেন? তাড়াতাড়ি ফিরে যান। এই মধুবনী থেকে নাথুয়া যাওয়ার রাস্তায় তেনারা বেরোন।’
বেশ সূর্যাস্তের শোভায় মশগুল ছিলাম। দিলে বেটা ভয় ঢুকিয়ে। এমনিতেই ইদানীং ইউটিউবে কিছু ভিডিও দেখার পর থেকে প্রাণীটাকে যতটা নিরীহ ভাবতাম, সে বিশ্বাস চটেছে, তার মাঝে এসব কেন হে বাপু?
সে আমার অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়াটা খেয়াল করল বোধহয়, বলল, জয় রামজীকি বাবু। কিছু ভাইবেন না। গনদেবতা সামনে আইসলে গড় হয়ে পরনাম করি লিবেন, ব্যস, মনে কিছু গলত শোচবেন ভি না, তাইলেই গনদেবতা জানতে পারবেন, প্যাঁচায়ে আসাড় মারবে বুইজবেন।
বুঝলাম। ফেরার পথ ধরা গেল। সন্ধ্যের অন্ধকার নামছে। জঙ্গলের ধার দিয়ে দিয়ে বাইক তিনটে হুসহুস গতিতে ছুটছে। আমি চারদিকে হাতি খুঁজছি। গণদেবতার অদর্শনের প্রবল কামনা জানাচ্ছি বিধাতাকে। সেই নদী এলো। আবার সেই কুস্তাকুস্তি করে বাইক নিয়ে পার হওয়া। পথে একখানা ময়ূর গাছে বসে দোল খাচ্ছিল। আমার দেখতে ভালো লাগলেও মন বসাতে পারলাম আর কই? মনে তখন ‘ওই শুনি যেন চরণধ্বণিরে...’
রাতে ফিরে শুনলাম আমাদের জন্য বাড়ির তিনজন মানুষই সারাদিন কিচ্ছু খাননি, সেই সকালে জলখাবার খাওয়ার পর। আমাদেরও মাথায় এলো, আমাদেরও কিছু খাওয়ার কথা মাথাতেও আসেনি। কিন্তু জেঠিমা আর তার বোন? তাই তো! ওনার বোনের কথা তো বলাই হয়নি। জেঠিমার বোনও এখানে আছেন ক’দিন। সে মহিলাও বিধবা। সব ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই দিদির কাছে এসে কিছুদিন কাটিয়ে যান।
সে যা হোক, লজ্জার সীমা রইল না। সারাদিন দু’জন বয়স্কা মানুষ অভুক্ত রয়ে গেলেন আমাদের জন্য, আমাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য। এতটা শহুরে হয়েছি, এতটা প্রয়োজনবাদী, ভোগবাদী, আত্মতৃপ্তিবাদী হয়ে পড়েছি যে, এ সব ভাবনা অনভ্যাসের হয়ে পড়েছে। স্মার্ট হতে শিখিয়েছে, এরকম বোকার মত ভালোবাসতে শেখায়নি তো কেউ!
৫
---
জলদাপাড়া যাওয়া হবে সবাই মিলে। আজ পঁচিশে ডিসেম্বর। প্রচণ্ড ভিড় হবে। তাই তাড়াতাড়ি গিয়ে লাইনে না দাঁড়িয়ে পড়লে ‘কার’ সাফারির টিকিট পাওয়া যাবে না।
আরে বললেই কি আর তাড়াতাড়ি হয়? একে শীতকাল, তায় মামাবাড়ি। গড়িমসি করতে করতে বেরোতে বেরোতে বাজল প্রায় আটটা পনেরো। ঘন্টাখানেক লাগল। পৌঁছে দেখি বিশাল লাইন। এক একটা ট্যুরিস্ট বাস গাদা গাদা লোক নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে। বেজায় হুজ্জুতি বেধে গেছে। লোকজনের উৎকন্ঠা দেখে হাসিই পাচ্ছিল, যেন আজকের দিনে জঙ্গলটায় ঢোকা, না ঢোকার উপর সবার জীবন-মরণ নির্ভর করছে। আদতে ব্যাপারটা তা তো নয়। ব্যাপারটা তো সেই ইগোর গপ্পো। আমি হেরে যাব? আমি পাব না? তবে কেউ পাবে না...
বাচ্চাগুলোকে দেখে বেজায় মজা লাগছিল। তারা বনে কি কি পাওয়া যেতে পারে, আর কোন কোন জন্তু সামনে এলে কি কি করা উচিত, এমন আত্মবিশ্বাসের সাথে তার বিবরণ দিয়ে যাচ্ছিল, তা বনদপ্তরের বহু বাঘাবাঘা লোকও পারবে না। বেশিরভাগেরই অনুপ্রেরণা কার্টুন, না তো ‘চাঁদের পাহাড়’। কত্তারা যখন লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিটের জন্য লড়ছেন, কর্ত্রীরা তখন সেলফিতে মশগুল। কেউ কেউ উৎসাহিত হয়ে যুদ্ধরত স্বামীর সাথে সেলফি নিতে গিয়ে গালাগাল খেয়ে ফিরে আসছেন, আবার কেউ কেউ সফল হয়ে।
এইসব দেখছি। টিকিটের লাইনের বহর দেখে বোঝাই যাচ্ছে আজ এত বেলায় এসে অসম্ভব টিকিট পাওয়া। কেউ কেউ শুনলাম প্রায় নাকি মাঝরাত থেকে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন, যেখানে কাউন্টার দশটার আগে খোলে না।
যা হোক, যা ভেবেছিলাম তাই হল। কাউন্টার খোলার মুহূর্তমধ্যেই সব গাড়ি বুক। আমরা অন্য প্ল্যান করছি, এমন সময় সুমন হুড়দুড় করে এসে খবর দিলে আরেকটা ‘মিছিমিছি’ জঙ্গল আছে। যেখানে পাঁচটা গাড়ি দেওয়া হয়। সেখানে পশুপাখীর তেমন দেখা না মিললেও জঙ্গলটা ভারী সুন্দর। কিন্তু কি করে হবে? গাড়ির হিসাবে গড়বড় হবে যে। আমরা নিজেরা ছ’জন, আর দেবাশিষের মামা আর তার বন্ধু রাজেশ, অর্থাৎ মোট আটজন। গাড়ি পিছু ছ’জনের বেশি যাওয়ার অনুমতি নেই। দুটো গাড়ি করতেই হবে। কিন্তু লোক না হলে দ্বিতীয় গাড়িটার সম্পূর্ণ খরচ আমাদের। তার থেকেও আমার যেটা ভয়, যে মাত্র দু’জনের যাওয়াটা জঙ্গলে কেমন ছমছমে ব্যাপার না? লোকবল বাড়লে তো মনোবলও বাড়ে। এমনিতেই গণদেবতার ত্রাসের ব্যাপার তো আছেই।
ঠিক হল তাই যাওয়া হবে। কাউন্টারে তখনো বিশাল গুঁতোগুঁতি। অনেকেরই ধারণা বেশ কিছু গাড়ি এখনও ইচ্ছাকৃতভাবে ছাড়া হচ্ছে না জলদাপাড়াতে। এরই মধ্যে সুমন আর শুভ (শুভজিৎ রায়) লাইনে ঢুকে পড়ল। একটা গাড়ি বুক করা হল। আরেকটা এবার। কাউন্টার থেকে বলল, দেখুন না আর যদি কেউ যায়, তবে এখানেও ছজন হয়ে যায়। অমনি শুভ আর সুমন নিলাম হাঁকার মত ডাকতে শুরু করল গলা চড়িয়ে... ‘আসুন... আসুন... ট্রলি সাফারিতে আমাদের সাথে আরো চারজনের জায়গা হবে... আসুন আসুন...
লোকজন পাওয়া গেল। মধুচন্দ্রিমায় আসা একজোড়া দম্পতি আর শিশু নিয়ে আরেক দম্পতি।
কিন্তু গাড়ি ছাড়বে সেই বিকাল তিনটে, এখন তো সবে এগারোটা। এতক্ষণ কি করা যায়? ঠিক হল টোটোপাড়ায় যাওয়া হবে। ঘন্টাখানেকের পথ। ‘টোটো’ একটা আদিবাসী সম্প্রদায়। তাদের সংখ্যা এতটাই কম যে তাদের জন্য সরকার থেকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত আছে। শুনলাম তাদের নাকি মাধ্যমিক পাশ করলেই চাকরি বাঁধা। গ্রামে পৌছালাম। আমি কিছু বিশেষত্ব বুঝলাম না গ্রামটার। একটা ছোটো সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র মতন আছে। হাস্পাতালই বলা চলে। একজন অল্পবয়েসী ডাক্তারের সাথে আলাপ হল। যাদবপুরের ছেলে, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। খুব সুন্দর কথাবার্তা। সেখানকার কিছু হালচালের কথা হল। বেশ আন্তরিক আর সিরিয়াস লাগল ছেলেটিকে। এমন একটা জায়গায় দিনের পর দিন থেকে, এরকম একটা গুরুদায়িত্বের ভার সামলানো অবশ্যই ছেলেখেলা নয়। সেখান থেকে বেরিয়ে একটু উঁচুতে উঠে পিকনিক স্পটে পৌঁছানো গেল। প্রচুর অল্পবয়েসী ছেলেমেয়ের ভিড়। বেশীরভাগই স্থানীয়। দামি দামি বাইক, পোশাক-আষাক অত্যন্ত কেতাদুরস্ত। দূরে দেখা যাচ্ছে তোর্সা নদী। শুকনো। মাইক চলছে গাঁকগাঁক করে... কি একটা অদ্ভুত টাইপের গান... ‘ফটো মেরা খিঁচলে...’ না এরকম কিছু একটা। তার সাথে ব্রহ্মরন্ধ্রভেদী বিট্স... ঘড়ি বলল, চলো জঙ্গলে যেতে হবে চাট্টি খেয়ে। এবার আমরা আগের দিনের মত ভুল করিনি, বাড়িতে বলেই এসেছিলাম দুপুরে খেয়ে নিতে।
বনদপ্তরের জিপসিতে উঠে যখন রওনা দিলাম তখন বাজে তিনটে পনেরো।
৬
---
তিস্তা ব্রীজের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা বেঁকে নীচের দিকে নেমে গেল নদীর ধার দিয়ে ধার দিয়ে। চমৎকার দৃশ্য। দূরে পাহাড়। নদীটা বেঁকে বেঁকে বিশাল চওড়া অববাহিকায় নেমে এসেছে, কালো তার জলের রঙ, বেশ বোঝা যাচ্ছে দারুণ স্রোত, খুব সুন্দর লাগছিল। তারপর শুরু হল জঙ্গল। বেশ ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের প্রতি আকর্ষণ আমার বরাবর ভীষণ তীব্র, বন্য জন্তুর ওপর অতটা না হলেও। চারদিকে ঘন জঙ্গলে হারিয়ে যাচ্ছি। জিপসিগুলোতে দাঁড়িয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা যারই আছে জানেন কি থ্রিলিং লাগে ওই সময়টা। যেন যে কোনো মুহূর্তে যা কিছুর সাথে সাক্ষাৎ হতে পারে, আমরা সবাই যেন উৎকণ্ঠিত সেই মুহূর্তটার জন্যেই। শুভ আর সুমন একটা বড় ধনেশ দেখতে পেল। আমি কিছুই দেখতে পাইনি। আমি রাস্তা দেখছিলাম। বনের মধ্যে বিশাল বিশাল গাছগুলোকে দেখছিলাম। ভাবছিলাম মাঝরাতে কেমন লাগে এইসব পরিবেশে কে জানে?
এই করতে করতে আমাদের প্রায় শেষ জায়গায় এসে পৌঁছানো গেল। জঙ্গলের বেশ গভীর অঞ্চল এটা। নববিবাহিতা দম্পতি ছবি তোলা শুরু করলেন। জঙ্গলের না। নিজেদের। ছেলেটার কোনো পোজ মেয়েটার পছন্দ না। সে শুধু একটাই কথা ছেলেটাকে বলে যাচ্ছে, 'ট্যালা কাত্তিক'। "এভাবে কেউ দাঁড়ায় ট্যালা কাত্তিক!"... "অমন ট্যালা কাত্তিকের মত কেউ হাসে?"... ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি তাদের থেকে মন সরিয়ে জঙ্গলে মনোনিবেশের চেষ্টা করলাম। একটা ওয়াচ টাওয়ার সামনে। হেঁটে কিছুটা এগিয়ে একটা স্পটে গিয়ে আবার নদীটাকে দেখতে পেলাম। শুকনো সাদা নদীর বুকটা আকাশের দিকে চিতিয়ে শুয়ে।
এবার ফিরতে হবে, প্রায় চারটে পঁচিশ হবে। আলো কমতে শুরু করেছে। মনটা সবার বেশ দমে আছে। কিচ্ছু মেলেনি রাস্তায়। কেউ কেউ কয়েকটা জঙ্গলচারী মামুলি গরুকে 'বাইসন' ভেবে যদিও আত্মপ্রসাদ লাভের চেষ্টা করেছে। তবু সুবিধা করতে পারেনি।
যদিও সবাই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলই যে এই সাফারিতে কিছু দেখা যায় না। এটা এক রকমের সান্ত্বনা সাফারি... তবু... মানুষের ‘বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না।’ সবারই খুব মন খারাপ।
ফেরার পথে কিছুটা আসার পর দেখি আমাদের সামনের গাড়িটা দাঁড়িয়ে। লোকজনের মধ্যে একটা চনমনে ভাব। আমাদের গাড়িটাকে দেখতে পেয়েই ওরা ইশারায় ধীরে ধীরে আসতে বলল। আমাদের বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে, কি আছে ওখানে?
দেখি একটা বিশাল হাতি। আমাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে। আমরা যে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম তার ডানপাশ দিয়ে একটা খুব সরু রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে মিশেছে। সেই রাস্তাটার দু’ধারেই ঘন জঙ্গল। বাঁদিকের জঙ্গলটা থেকে ডাল ভাঙার মড়মড় আওয়াজ হচ্ছে। আমাদের গাইড বলল, অনেক বড় দল মনে হচ্ছে, আপনারা খুব লাকি।
ইতিমধ্যে পিছনে আরো তিনটে জিপসি এসে দাঁড়িয়ে গেছে। সবাই স্টার্ট বন্ধ করে রুদ্ধশ্বাসে কি হয় কি হয় অপেক্ষা করছে। এরকম সময় আরেকটা প্রকাণ্ড হাতি তার বাচ্চাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। মাঝপথে দাঁড়িয়ে একবার আমাদের গাড়িগুলোর দিকে তাকালো। সে তাকানো কি সাংঘাতিক। যেন মেপে নিল। আমার তো তখন ভয়ে উত্তেজনায় গলা প্রায় শুকিয়ে এসেছে। ফটাফট ছবি উঠছে। খচখচ আওয়াজ। গাইডরা ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ব্যবহার করতে বারণ করলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। দু’জন ড্রাইভার দু’জনের দিকে কিছুটা উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করলেন। তবে কি কোনো আগাম বিপদ তারা টের পেয়েছেন? চারদিকে তাকিয়ে যা বুঝলাম, কোনো গাড়িরই ডানে-বাঁয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। হয় সামনে নয় পেছনে এগোতে হবে। কিন্তু পাঁচটা জিপসি যেভাবে গা লাগালাগি করে দাঁড়িয়ে তাতে চট করে আগুপিছু করাও সম্ভব না। হাতিগুলো যে জঙ্গলে ঢুকছে সেটা আমাদের ফেরার পথের ঠিক ডানহাত বরাবর। তাদের মধ্যে একটাও যদি সামনের দিকে এসে পড়ে, কিম্বা পিছনের জঙ্গল থেকেও যদি একটা বাইরে এসে পিছনে দাঁড়ায়, তবে?
ভয়ে ভয়ে গাইডকে বললাম, ‘আপনাদের কাছে হাতি তাড়ানোর কিছু আছে ভাই?’ সে মাথা নাড়ল। মানে নেই। তবে? পালাতে হবে। কিন্তু পথ কই? গাইড বললে, সেই তো বিপদ, তবে আগে থেকেই বলে রাখি, যাই হোক গাড়ি থেকে নামবেন না...
আমার বুকের শব্দ আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি। কিছুটা দূরে মা আর বাচ্চা হাতি। পিছনে অতি নিকটে মড়মড়, পটাস পটাস ডাল ভাঙার আওয়াজ, ওদিকে দিনের আলো কমে আসছে, পাখিদের ঘরে ফেরার কলতান... মাঝে আমরা কয়েক গাড়ি মানুষ। মনে মনে ভাবছি চেপে মারবে, না শুঁড়ে তুলে আছাড় মারবে? বাচ্চাটা যদি 'মাম্মি গাড়ি' বলে একবার এদিক পানে ছুটে আসে, আর তার পিছন পিছন ওই হেভি ওয়েট আম্মি, তবে তো কম্ম সাবাড়। আমি হামাগুড়ি দিয়ে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসলাম, কাকুতি-মিনতি করে বললাম, এবার গাড়িটা ছাড়ো না ভাই, হোলো তো মেলা হাতি দেখা, আর কেন প্রাণ সংশয় বাড়াও চাঁদ আমার!
সে বেটা এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে, আরেক হাতের নখ দাঁতে কাটতে কাটতে বলল, ‘আপনি তো হেব্বি ভীতু, ওই হাতিটা সামনে এসে দাঁড়ালে তো আপনার হার্টফেল হয়ে যাবে মনে হচ্ছে...’
মনে হচ্ছে?! এখনও মনে হচ্ছে...!!! ওরে উজবুক আমি কি আর জঙ্গলে থাকি, যে চলতে ফিরতে হাতির মুখোমুখি হই? এমন পথ আটকে দাঁড়িয়েছে কোনোদিন হাতি আমার এর আগে? পথ আটকিয়েছে সিপিএম, তৃণমূল, কংগ্রেস, বিজেপি এরা সব... হাতি কই?
তারপর তার মনে বোধহয় আমার জন্য কিঞ্চিৎ দয়ার উদয় হল। সে খুব আশ্বস্ত করে আমায় বললে, ‘এখন এগোনো যাবে না দাদা, সামনেই বড় হাতিটা আছে তো... তাড়া করতে পারে...’
আহা... শুনে প্রাণ জুড়িয়ে জল হয়ে গেল আমার। ভাবলাম হাতিপদহত হওয়ার আগে ফেসবুকে শেষ স্টেটাসটা দিয়ে যাই... feeling dying…
কতক্ষণ সেভাবে কাটল বলতে পারব না। হাতিমুক্ত হয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফের চলতে শুরু করলাম। কি আনন্দ... আহা... যেন কিছু একটা পাচ্ছে... প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না, বড়টা না ছোটোটা... দেহের অগ্র-পশ্চাৎ জ্ঞান হারিয়েছিলাম... খানিক বাদে বুঝলাম কিছুই পাচ্ছে না, তলপেটের মাংশপেশীগুলো শিথিল হচ্ছে...
জলদাপাড়া ফরেস্ট অফিসের সামনে এলাম যখন পাঁচটা কুড়ি। প্রচুর সাফারি ফেরৎ বাঙালীকুল। কে ক’টা কি জাতীয় জন্তু দেখেছেন তাই নিয়ে কম্পিটিশান চলছে। বাঙালী থাকবে আর ঈর্ষা থাকবে না, তাই হয়? তেল ছাড়া চপ হয়?
যা হোক, আমাকে এক টাকলা ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু পেলেন? মুখের বক্র হাসি দেখে মনে হল নিজের হাতের তাসটা লুকিয়ে আমার হাতের তাস দেখার চেষ্টা। এমনিতেই তখন আমি নবজন্ম লাভের আনন্দে মশগুল। বেজায় উৎসাহের সাথে বললাম, ‘আর বলবেন না মশায়, জীবনে ভাবিনি এরা এই জঙ্গলে থাকে। মানে একটা ক্যাঙ্গারু। বলব কি মশায়, এই এতটা হবে’, বলে প্রায় নিজের ছাতির কাছ অবধি হাতটা এনে বললুম, ‘গাছে বসে দোল খাচ্ছিল জানেন আর শিস দিচ্ছিল... পিউ কাঁহা... পিউ কাঁহা...’
তেনার মুখের অবস্থা দেখার জন্যে আর দাঁড়ালাম না। গাল পাড়ছেন বেশ বুঝলাম। কিন্তু আমার দাঁড়াবার সময় নেই আর, এবার যেতেই হবে, বড় না, ছোটো বাইরে...
অন্ধকার চারদিকে গাঢ়। গাড়ি ফিরছে দেবাশিষের আরেক আত্মীয়ের বাড়ির দিকে, ধুপগুড়ি শহরেই তাদের বাড়ি।
৭
---
আমাদের কাজের দিদি প্রায়ই আমায় তাদের গ্রামে যেতে বলে, সুন্দরবন। যাব নিশ্চই একদিন। সে বলে, ‘জানো দাদা, মানুষের বেশি পয়সা থাকলে মন থাকে না।’
কাল ফেরার দিন। আজ শেষ রাত। গল্পে গল্পে রাত গড়ালো। শুতে গিয়ে বারবার কিছু মানুষের মুখ ভেসে আসতে লাগল যারা কয়েক ঘন্টা আগেও ছিল একদম অপরিচিত। আজ তাদের কাছে আবার ফেরার তাগিদ অনুভব করছি। দুই মাসির বাড়ি দেবাশিষের, ফালাকাটার ভবেশবাবুর অত্যন্ত অতিথিবৎসল পরিবার। সব মিলিয়ে মনটা কেমন আচ্ছন্ন হয়ে রইল। বাইরেটা সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আকাশ ভরতি তারা। স্বচ্ছ আকাশ। কুয়াশা নেই আজ। মাঝে মাঝে কয়েকটা কুকুরের ডাক ভেসে আসছে দূর থেকে। যে বাড়িটায় প্ৰথম দিন অপরিচিত ছিল কি করে এত পরিচিত হয়ে গেল ভাবতে অবাক লাগছিল।
আমার পাশের ঘরে যে বৃদ্ধা রমণী ঘুমিয়ে আছেন বারবার তার মুখটাই মনে পড়তে লাগল। এমন নিশ্চিন্ত, শান্ত জীবন মানুষ বাঁচে কিসের শক্তিতে? প্রাচুর্য কি সত্যিই মানুষকে অমানুষ করে দেয়? এত দাবী আমাদের জীবনের কাছে যে এক জীবনে তা পূরণ হওয়া অসাধ্য। তবু চাই। চাই, চাই, চাই... বলতে বলতে আমাদের থামাটা আর হয়ে ওঠে না কোথাও। কোথাও দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে যেন বলতে পারি না, এই যা পেয়েছি তাই ঢের, যথেষ্ট! সে আর বলা হল কই?
বাইরে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। জেঠিমা তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। মুখে খুব জোর করে একটা হাসির আভা মাখিয়ে রেখেছেন। চোখ অন্য কথা বলছে। জলে ভেজা নদীর বুক। পাড় ভেজাচ্ছে চুপিচুপি। সময় হয়ে যাচ্ছে ট্রেনের। একে একে প্রণাম করলাম। বিশেষ কিছু বললেন না, শুধু বললেন, আবার এসো।
গাড়ি ছুটল ধুপগুড়ি স্টেশানের দিকে। দু'দিনে আপন হয়ে ওঠা চেনা রাস্তা, চা-বাগান, দোকানপাট, স্কুল সব পিছনে মিলিয়ে যেতে লাগল।
হরি আর রাজেশ এলো ট্রেনে বিদায় জানাতে। মনটা চুপ। ফেলে আসা ঘরটার চারদিকে চরকি কাটছে। কি যত্ন করে অত অল্পবয়সী মেয়েটা সব গুছিয়ে রাখত ঘরে আমরা বাইরে গেলেই। তার কোনো দাবি ছিল না, অভিযোগ দেখিনি, ক্লান্তি দেখিনি। অদ্ভুত তৎপরতায় সারাটাদিন কাজের স্রোতে ছুটে চলেছে।
শীতের সকাল। ধুপগুড়ি স্টেশানের চারদিকটা দেখতে দেখতে মনে হল প্রকৃতির মধ্যেও এরকম অল্পবয়সী মেয়ে আছে। কেমন পরিপাটি করে চারদিক গুছিয়ে রেখেছে। গাছটা, আকাশটা, কেউ যেন নিজের জায়গা ছেড়ে দুষ্টুমি করে না বেড়ায় তার খেয়াল রেখেছে। চারদিক মনের মত গুছিয়ে সে যেন ওই নদীর জলে নাইতে গেছে। দেখতে দেখতেই চোখে পড়ল আটটা কুকুরছানা। তাদের মায়ের সাথে ঘুরছে ফিরছে। তারা যতক্ষণ তার বুকে মুখ লাগিয়ে দুধ খাচ্ছে, সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। হাজার হোক মা তো। জেঠিমার কথা মনে পড়ল - যার মা নেই, তার যে সারা জগতে কেউ নেই।
আরে কেউ নেই বললেই হবে, আমার বাড়ির উঠোনে পাঁচটা কুকুরছানা আছে না। তাদের ছেড়ে আসতে আমার কষ্ট হয়নি বুঝি? হয়েছে তো। আমার কেউ থাকুক না থাকুক, তাদের তো আমি আছি। ফেরার দড়িতে টান লাগল।
ট্রেন এলো। হরি, রাজেশকে বিদায় জানিয়ে ট্রেনে উঠলাম। "এত কমদিনের জন্য আসতে হয়? পরেরবার বেশিদিন ছুটি নিও কিন্তু"।
জীবন মানে তো নদী। নদীতে যেমন পলি জমে। জীবনেও তেমন পলি জমে। ছাঁচতে হয় তখন। কিভাবে হবে? বেরিয়ে পড়ো। পাহাড়-নদী-জঙ্গল না, অজানা, অচেনা মানুষের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াও। একটা লম্বা শ্বাস নাও। দেখো কত নতুন গন্ধ। নতুন মানুষের জীবনের গন্ধ। কোনো মানুষের জীবনের গল্পই তার একার না। সবার গল্প। সে শুনতে শুনতেই পলি কাটে। স্রোত আসে। পুরোনো ভালোবাসা নতুন খাতে বয়।
(ছবির জন্য কৃতজ্ঞ দেবাশিষের কাছে)