Skip to main content
 
 
      একে ব্যস্ত বাজারের রাস্তা, তায় দু-ধারে ঝুলনের মেলা। তার ওপর প্রচণ্ড একটা ভ্যাপসা গরম। আমি রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চে। রবিবারের সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে ছুটির আমেজে। 
      এক হাতে রিকশাটা চালিয়ে গাড়ি-ভিড় সামলিয়ে একটা পাশে রাখলেন। ময়লা লুঙ্গি, ছেঁড়া জামা, রোগা শরীর, গালদুটো ভাঙা, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। একটা চা – বলে দাঁড়ালেন পরিস্কার জামাগুলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে কিছুটা দূরে। ডান হাতটা কাঁপছে। হাতে কি ধরা ওটা খবরের কাগজে মোড়া? চপ। তেল চুপচুপে হয়ে গেছে কাগজটা। চা নিয়ে বেঞ্চের এক কোণায় রাখলেন। রিকশার সিটটা তুলে একটা মোড়া ঠোঙা বার করলেন। মুড়ি আছে। বেঞ্চের কোণায় বসলেন। পাশে চায়ের গ্লাস। লিকার চা, ধোঁয়া উঠছে। কাঁপা কাঁপা হাতে মুড়ির প্যাকেটটা খুলে, আরেক হাত থেকে চপটা ওর মধ্যে রাখতে চাইছেন, পারছেন না। হাতটা কাঁপছে। আমি উল্টো দিকের বেঞ্চে। আমার ওনার মধ্যে হাজার হাজার বছরের লালিত সভ্যতার অভ্যাস, উঠে যেতে পারছি না। পরিষ্কার জামা আর নোংরা জামার দূরত্ব অনেক। 
      চপটা মাটিতে পিছলে পড়ে গেল। হাতে তেল চিপচিপে খবরের কাগজটা। মাটিতে একবার তাকালেন, সাথে সাথে তুলে পাশে ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন, কুকুরটা এগিয়ে আসার আগেই। তারপর তেল চিপচিপে কাগজটা চেটে সেটাও ফেলে দিলেন ডাস্টবিনে। শুকনো মুড়ি চিবোচ্ছেন। সাথে তীক্ষ্ণ বর্শার ফলার মত উঁচু অ্যাডমস অ্যাপেলের ওঠা-নামায় চায়ের ঢোক। মুখেচোখে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই। চোখ ফিরিয়ে তাকাচ্ছেনও না ডাস্টবিনটার দিকে। কুকুরটা ডাস্টবিনের পেটের নাগাল না পেয়ে ওনার মুড়ি খাওয়া দেখছে মাটিতে পাছা ঠেকিয়ে বসে ল্যাজটা মাটিতে ঘষে ঘষে। দুটো মুড়ি ছড়িয়ে দিলেন। 
      বাজারেই ঘোরে বস্তা বুকে পাগল। সারা শরীরটা কালো। পোশাকও শতছিদ্র কালো। সে এত কিছু নজরে রেখেছে। পেট তো পাগল হয় না। মাথা হয়। ডাস্টবিন থেকে চপটা সরু কালো হাতটা গলিয়ে তুলল। মাটিতে বসে কামড় লাগাল চপে। কুকুরটা এগিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে এখন। বেঞ্চে বসে চপের ভূতপূর্ব মালিকও দেখছেন উদাসীন চোখে। পাগল কিছুটা চপ ছিঁড়ে দিল কুকুরটার মুখের সামনে। 
      তিনজন আমার সামনে। একজন ক্ষোভহীন মানুষ। একজন লজ্জা-ঘৃণাহীন পাগল। একটা সংযত কুকুর। কেউ কাড়াকাড়ি করছে না। কেউ ক্ষুব্ধ হচ্ছে না। কেউ কামড়েও দিচ্ছে না। আমার পাশে শয়ে শয়ে মানুষ। বাজার ভর্তি পণ্য। বাজার ভর্তি প্রয়োজন, লোভ, ক্ষোভ, অভিশাপ, অসন্তোষ। 
      খানিক আগে আমি টনি মরিসনের কিণ্ডলে পড়া দুটো বইয়ের হার্ডকপি অর্ডার দিলাম। দাম সাতশো ছাড়িয়েছে। বিলাসিতা? আমি জানি টনি ওতে যে মানুষদের কথা লিখেছেন, আমার সামনেই তারা বসে। বঞ্চিত মানুষের লিঙ্গ-দেশ-কালের ভেদ হয় না। কিন্তু আমি কিনতে চাইছি কেন? তবে কি আমি এই কঠিন বাস্তবটাকে ইন্টেলেকচুয়ালাইজ করে প্রত্যক্ষ অস্বস্তিকর অনুভব থেকে পালাতে চাইছি? আমার তো এমন ক্ষতি সহ্য করে নেওয়ার অভ্যাস নেই, এমন নির্লিপ্ততা, এমন উদাসীনতা নেই। তবে কিসের জন্য পড়ছি? কেন পড়ছি? বিলাসিতা? আমি যদি টনি মরিসন না পড়ে একটা সস্তা রোম্যান্টিক উপন্যাস পড়ি, সেও কি বিশেষ কিছু পার্থক্য হবে আমার কাছে? দুই-ই তো সমান অবাস্তব আমার জীবনে। আমার সব কিছুকে ভাষার মধ্যে দুই মলাটের মধ্যে দেখার প্রবণতা কি বিলাসিতা নয়? হয়ত উঁচুদরের। হয়ত বা মার্জিত সভ্যতার একটা সুনিয়ন্ত্রিত আত্মগত অবকাশ যাপন। আমার অভিধানে আমার সামনের দুটো মানুষের অভিধানের থেকে শব্দ সংখ্যা বেশি। নিঃসন্দেহে বেশি। নানা ভাষায় বেশি। কিন্তু জীবনের প্রতি আবেদনে এদের শব্দের তীব্রতা বা তীক্ষ্ণতার পাশে কি আমার শব্দের ধার দাঁড়ায়? দাঁড়ায় না। বড্ড পেলব, বড্ড শৌখিন আমারগুলো, ব্যাকরণের পরীক্ষায় পাশ করে, কালের পরীক্ষায় না। 
      আসলে এই না পারাটা, এই নিজের রুক্ষ রূঢ় বাস্তবকে অস্বীকার করে দাঁড়িয়ে থাকাটা আমার সহজ করে দিয়েছে আমার চারদিকে ভাষার তৈরি চিন্তার নানা কুশলী যুক্তির জগত, সভ্যতার নানা হায়ারার্কিতে তৈরি শক্ত অভ্যাসের ভিত। যার টাকার অঙ্ক অনেকগুলো সংখ্যা ছাড়িয়ে দাঁড়ায় সে মানুষের অভাবের বিলাপেও আমার অস্বাভাবিক লাগে না। কারণ ওই যে নীচের সারির হায়ারার্কিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর উপরে দাঁড়াতে না পারলে আমরা অ্যাচিভ করলাম কি? মানুষকে ছাপিয়ে মানুষকে ব্যবহার করার ক্ষমতা অর্জন করতে না পারলাম তো আমার কিসের যোগ্যতা?
      কদিন পর আমার বইদুটো আসবে। আমি একটা মার্কার বানিয়ে শুয়ে বসে পড়ব। শোষিত বঞ্চিত মানুষের কথা পড়ব। আলোচনা করব। তারপর আমার ক্ষোভ অভাবকে জাস্টিফাই করব। রাসেলের মতে “স্ট্রাগল ফর প্রেস্টিজ” এর সংগ্রামে গা ভাসিয়ে আবার অন্য বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকব। নিজেকে প্রতিদিন ঠকাবো। নিজের ভাবনা চিন্তাকে প্রতিদিন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মনে করব। নিজের হুকে আটকিয়ে নিয়ে নিজের সংসারটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে বেড়াতে থাকব। কখন আমার নাগরদোলা থেকে নামার সময় এসে যাবে, পরের পাতা উল্টে যাবে। 
      তবু এর মধ্যে কয়েকবার যদি চোখটা খুলে বলে যেতে পারি, আসলে আমিও একটা ভীষণ বানানো ভণ্ড সমাজের গর্বিত সদস্য ছিলাম, মনটা হাল্কা লাগে। অক্ষরগুলোকে বলি শুদ্ধ হও, সরল হও, সন্তুষ্ট হও। আমায় পথ দেখাও। যদিও এই চাওয়টাও যে নির্ভেজাল নয় সেও কি আমি জানি না?