মহাপ্রভুর চরণচিহ্ন। তার উপরে চন্দনের প্রলেপ। কয়েকটা তুলসী। পূজারী ইশারা করল, চন্দন মাখা তুলসী নাও। মাথাও ছোঁয়াও। বুকে ধরো।
বৃদ্ধ পূজারী। চশমার কাঁচের আড়ালে দুটো বিস্ফারিত চোখ। পাশেই বিশাল মন্দির। জগন্নাথদেবের। পতাকা উড়ছে হাওয়ায় পত পত করে। সেখানে মানুষের ভিড় উপচে পড়ছে। মহাপ্রভুর পায়ের কাছে বসে এই বৃদ্ধ পূজারী আর এক বৃদ্ধা রমণী। হাতে ফুল।
মহাপ্রভু। নাম। নৃত্য। গীত। স্তব। শুধু কি এই?
প্রেম নেই। শুষ্ক হৃদয়। আসলে হৃদয়ই নেই। সব কিছুকে নিজের কাজে লাগানো যায়। হৃদয়কে নয়। হৃদয় বাইরের দিকে খোলে। ভিতরের দিকে ডাকে। হৃদয়কে চাকর করা যায় না। হৃদয় রাধার অনুগামী হয়। মৃত্যুর অনুগামী হয়। লোভের? কদাপি নয়।
মহাপ্রভু বলেননি ঈশ্বরকে দর্শন করো। ঈশ্বরের তত্ত্ব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করো। মহাপ্রভু বলেছেন, ভালোবাসা আনো। জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরের উপর ভালোবাসা। ঈশ্বর ছাড়ো, একটা স্নিগ্ধ ভালোবাসা জন্মাক। তোমায় কেউ পূর্ণতা দিতে পারে না, এক ভালোবাসা ছাড়া। জ্ঞান মানে ভালোবাসা। যখন জ্ঞান মানে অনুভবের সজীব সজাগতা।
ভালোবাসায় জেগে থাকা, আর কর্তব্যবুদ্ধিতে জেগে থাকা কি এক? ভালোবাসা জাগিয়ে রাখে ব্যথায়। কর্তব্যবুদ্ধি জাগিয়ে রাখে ভয়। বিচ্যুত হওয়ার ভয়। সে-ই ভয়ই কি মানুষের জীবনের একমাত্র দিশা নির্ধারক? তবে কিভাবে সন্তানকে ভালোবেসে, সর্বস্ব দিয়েও পিতামাতা ভাবে কিছু দেওয়া হল না? সে-ই ব্যথায় জেগে থাকা। কর্তব্যবুদ্ধি কর্তব্যের পরিপূর্ণতাতেই শান্ত। মুক্ত। ভালোবাসা চিরটাকাল অপূর্ণ। চিরকাল অধীনস্থ।
সব কর্তব্যবুদ্ধির শেষে দাঁড়িয়ে থাকেন মহাপ্রভু। এক নতুন ব্যথায় কাঁদাবেন বলে। যে কান্না মানে আনন্দ। যে কান্না মানে বল। যে কান্না মানে চারদিকের সব কিছুর স্বচ্ছতা, স্বস্থতা। যে কান্না মানে সব ক্ষোভ-শোকের চিরকালের পরাভব। তারপর এক সর্বগ্রাসী অভিনব ব্যথায় জেগে থাকা। সেদিন ভক্ত তাকিয়ে দেখে গোটা জগত এক তীব্র ভালোবাসার বেদনায় জেগে আছে। সকল বস্তুকে জাগিয়ে রেখেছে যে চেতনা, সে চেতনা প্রতি মুহূর্তে নিজেকে বিস্তারিত করছে যে প্রেরণায়, সে এক অনির্বচনীয় ব্যথা। যার আরেক নাম প্রেম। গোটা জগতে তখন কোনো প্রশ্ন নেই আর। আছে নিজেকে সেই অসীম যন্ত্রণার অংশীদার করে তোলা। সেই সুরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নেওয়া। ব্যথাই পথ। ব্যথাই আলো। ব্যথাই জাগ প্রদীপ। মহাপ্রভু তার কাণ্ডারী।
কর্তব্য দেশ-কাল-পাত্র অনুযায়ী বদলে যায়। যা প্রাথমিক, তা-ই কখনো গৌণ হয়ে পড়ে শুধু সময়ের ইঙ্গিতে। গোটা সংসার এই দুরূহ কর্তব্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। এক সময় কর্তব্যবুদ্ধি এমন বিকারগ্রস্ত হয়ে ওঠে, তখন মানুষ বলে আমার স্বার্থরক্ষাই আমার একমাত্র কর্তব্য। তার জন্যে তোমার গলায় ছুরি বসিয়ে দিতেও আমার হাত কাঁপবে না। কারণ সে আমি কর্তব্যবুদ্ধিতেই করেছি। সে সময়ে সে বিকার থেকে বাঁচায় ভালোবাসা, যে ভালোবাসার পাঠ শুরু হয় নিজেকে শূন্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। দীনতার উপলব্ধি হওয়া অপরাধের কিছু নয়, সঙ্কীর্ণ অনুভব অপরাধের। কর্তব্যবুদ্ধি অপরাধের কিছু নয়, কিন্তু "আমি ছাড়া জগত নিশ্চল", এমন বিকার অপরাধের। অপরাধ ঈশ্বরের কাছে নয়, অপরাধ স্ব-হৃদয়ের ভালোবাসতে পারার অনাবিল ক্ষমতার কাছে। যে ক্ষমতা সে নিয়েই জন্মেছে। কিন্তু রাষ্ট্র, শিক্ষা, সমাজ তার মাথায় কৃত্রিম কর্তব্যবুদ্ধি চাপিয়ে দিয়ে তাকে একটা দলের সদস্য করে তুলে বলে, এই দল রক্ষা করাই তোমার একমাত্র কর্তব্য। তার জন্যে অন্যের প্রাণ ছিনিয়ে নেওয়াও কর্তব্য বইকি!
ভালোবাসা এ খাই থেকে আমাদের বাঁচায়। প্রাণকে জাগাতে হবে এ ভালোবাসায়। নাম সঙ্কীর্তন তো উপায় মাত্র। উদ্দেশ্য তো নয়। উদ্দেশ্য হল প্রেম। নিষ্কলুষ, নিষ্পাপ এক স্নিগ্ধ প্রেম। যদি তুমি বলো আমি জানি জগতে কোনো ঈশ্বর নেই, সবটাই ভ্রম.. মিথ্যা গল্প…. তাও মহাপ্রভু বলবেন, তবু বলি নম্র হও, সহনশীল হও, অন্যকে মান দাও, সত্যের কীর্তন করো। উদ্ধত দৃষ্টিতে যে সত্য চোখে পড়ে না, নম্র দৃষ্টিতে সে অনায়াসে চোখে পড়ে। আর নম্র দৃষ্টির সামনেই জন্মায় কোমল পৃথিবী… বাঁশি বেজে ওঠে। নম্র শ্রবণ বলে, আমি আসছি। এত কোলাহলের মধ্যেও বাজছে এমন সুর!
নম্রতার ঘাসে ভালোবাসার শিশিরবিন্দু জমে। সে শিশিরে কার চরণ ভিজে ওঠে। প্রসন্ন চেতনা বলে ওঠে, আমি দাস। আজীবন দাস। এইটুকুই শুধু বলার ছিল, প্রেমে। সে এক প্রবল শক্তির অধিকারী হয়। যে শক্তি বলি চায় না, যে শক্তি গোটা জগতের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, আমাকে নিশ্চিহ্ন করবে, সে শক্তি তোমার নেই। মোহের ভরে দাঁড়িয়ে তোমার চীৎকার, আমার কাছে বালখিল্য মাত্র। আমি যাঁর দাস, তিনি অসীম অন্তত ভালোবাসার আধার। আমি তার একটা ঢেউ মাত্র। আমি তার বুকে ডুবি, আবার হই। আমায় শূন্য করতে হলে শূন্যের সাক্ষীকেও করো শূন্য। সে হয় না। জগত এক জাগ্রত চেতনা। যার বেদনার নাম ভালোবাসা।