Skip to main content

বাড়ির সবাই মন্দিরে। ভূষণবাবু সমুদ্রের ধারে বসলেন। মন্দিরে যান না। শ্রদ্ধা ভক্তি কি জোর করে আসে?

চায়ে চুমুক দিতে দিতে খেয়াল করলেন সমুদ্রের উপর কালো মেঘ তিরপলের মত ছেয়ে আসছে। কে যেন টেনে টেনে আনছে।

পাঁচটা কুড়ি। রোদটা কমে এসেছে। ভূষণবাবু পাঞ্জাবীর ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে সিগারেট, আর দেশলাইটা বার করলেন। দুবারের চেষ্টায় জ্বলে গেল। কাঠিটা ফেলে চেয়ার ছেড়ে সমুদ্রের ধারে এসে দাঁড়ালেন, হাওয়াই চটিটা বালিতে খুলে।

হাওয়ার জোর বাড়ছে। মাথায় ভাবনাগুলো এলোমেলো হচ্ছে। কেউ কেউ বলে পুরীর মন্দির নাকি আগে বুদ্ধ মন্দির ছিল। হঠাৎ এ কথাটা মাথায় এলো কেন? কদিন আগে বুদ্ধপূর্ণিমা গেল বলে? আচ্ছা সংসারে দু:খ আছে, এটা বুঝতে অত কষ্ট করে, অত ধ্যানট্যান করতে কেন হল? সংসারে কয়েক বছর কাটালেই তো বোঝা যায়। আর সবের মূল যে নিজেরই বাসনা সেটা বোঝাও কি খুব শক্ত? না চাইলেই না পাওয়ার দু:খ থাকে না। আর অষ্টাঙ্গিক মার্গ, সেকি সংসারে হয়? ভূষণবাবুর মদের ব্যবসা। পরিবারসূত্রে জমিজায়গাও অনেক। কিন্তু সুখ? নেই। ছিঁটেফোঁটাও নেই। সুখের খোলস আছে শুধু। রঙিন খোলস।

=====

"মার্কেটিং করে আসব।"

মনোরমা লিখল। আটত্রিশ বছরের সম্পর্ক। এক মেয়ে। জামাই আর নাতনিও এসেছে সঙ্গে। জামাই ডাক্তার। নিজের নার্সিংহোম আছে। সৎমার্গ মানে কি? না জামাই বোঝে, না ভূষণবাবু নিজে। কিন্তু সবই তো চলে যাচ্ছে। জগতে দু:খ সত্য না, পাপ সত্য। পাপের মেঘের আড়াল। মাঝে মাঝে সূর্যের আলোর মত পুণ্য উঁকি দিয়ে চলে যায়। ধরে রাখা যায় না। ভূষণবাবু চানও না।

"দাদা সিগারেট হবে একটা?"

পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরা বদখত দেখতে একজন। দেখেই গা পিত্তি জ্বলে গেল। দাঁত হলুদ, হাসিটা বাজারের অ্যাডগুলোর মত টাঙিয়েই রেখেছে মুখে…. শালা প্যারাসাইট….

সিগারেট বার করে দিলেন। বললেন, দেশলাই হবে না।

লোকটা হেসে পকেট থেকে একটা দেশলাই বার করে একবারেই ধরিয়ে বলল, কথাটা পাপটাপ না… আপনার ভাবনা…

চমকে উঠে ভূষণবাবু বললেন, মানে?

সে বলল, মানে আপনার ভাবনার গোড়ায় ভুল হচ্ছে। আপনি সমুদ্রে মারসিডিজ চালাচ্ছেন।

ভূষণবাবু বললেন, মশায়ের কি চড়ানো হয়ে গেছে নাকি? রাস্তা দেখুন… এটা আড্ডার জায়গা না….

ঠিক, তাই বলছিলাম, ওইসব বুদ্ধ-টুদ্ধকে নিয়ে ভাবনার মানুষ আপনি নন… এক-একটা মনের এক একটা টেরিটোরি থাকে, বুঝলেন কিনা…. এই যে আপনি মনে মনে আশঙ্কা করছেন বৌদি কত খরচ করে ফেলবে…. মানে কুড়ির উপরে যেন না যায়…. সেটা আপনি লিখতে চাইলেও লিখতে পারছেন না…. কারণ সঙ্গে জামাই আছে…

ভূষণবাবু বললেন, চা খাবেন?

=====

দুটো চেয়ার একটু আলাদা টেনে দুজনে পাশাপাশি বসে। ভূষণবাবু কথা খুঁজছেন। লোকটা তিনটে প্রশ্নের উত্তর দেবে বলেছে। তার বেশি না। পনেরো মিনিট সময় দিয়েছে। কিন্তু এই বয়সে এসে কৌতুহল আর উৎসাহ দুটোই এত কমে গেছে যে মনে হচ্ছে কিছু না জানতে চাইলেই তো হয়…. কি জানার আছে? বিজনেস ভালো চলছে। মনোরমার এক্সট্রা ম্যারিটাল আছে। তার নিজেরও আছে। জামাইয়ের জুয়ার নেশা আছে। মেয়ে বাইপোলার। নাতনি….. থাক ওইটুকু না জানাই থাক….

বৃষ্টি হচ্ছে না। হাওয়া দিচ্ছে খুব জোরে জোরে। ভূষণবাবু বললেন, কিচ্ছু জানার নেই জানেন…. আপনি বলুন…. কিছু কি আমার জানার আছে?

লোকটা বলল, এই আপনার প্রথম প্রশ্ন… আরো সাড়ে সাত মিনিট হাতে আছে…..

ভূষণবাবুর বগল চুলকাচ্ছে। উদ্বেগে হয়। কিন্তু কিসের উদ্বেগ? আসলে সময় চলে যাচ্ছে ভাবলেই একটা উদ্বেগ হয় মানুষের… কিন্তু কি যে করার ছিল জীবনে… বা কি যে করা উচিৎ…. সেটাই কেউ জানে না…

কি করা উচিৎ..?

তৃতীয়? আর দু মিনিট আছে….

যদি না প্রশ্ন করি কিছু… কি হতে পারে?

=====

লোকটা বলল, আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর হল, জানার কিছু নেই…. জানা আর ভোলার মধ্যে পার্থক্য শুধু সময়ের…. জেনে কিছু হয় না…. ভোলার কাজে লাগে শুধু….

দ্বিতীয় প্রশ্ন… কি করা উচিৎ….

এটা প্রশ্ন না। এটা তিরপল। যা যা করেছেন বা করবেন ভাবছেন তাকে ঢাকার জন্য ঔচিত্যের তিরপল খুঁজছেন… তাই মেঘ দেখে আপনার মনে হয়েছিল তিরপল…. মানুষ নিজেকে ঔচিত্যবোধ জাগিয়ে ঢাকে… আড়াল করে…. আসলটাকে….

আর তৃতীয় প্রশ্ন…. যদি কিছু প্রশ্নই না করতেন…. কিছুই হত না…. কারণ মানুষ যা জানে না… তা শোনে ভোলার জন্যে… আর যা জানে তার পুনরুক্তিতে সে নিশ্চয়তা খোঁজে…. কোনো কিছুরই নিশ্চয়তা নেই জেনেও…. বারবার তাই মন্ত্র আওড়িয়েই যায়… নিজের ঘোরে নিজেকে বাঁচাবে বলে…..

=====

ভূষণবাবু বসে থাকলেন। লোকটা তার দেশলাইয়ের প্যাকেটটা ভূষণবাবুকে দিয়ে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, আমি কে… এ প্রশ্ন আপনার মনে উদয় হবে আর আধঘন্টা বাদেই…. আপনার সিগারেট আমার দেশলাইতে ধরাবেন…. ধোঁয়া উড়বে…. ভাববেন আমি ওই…. ধোঁয়া…. কোনো সংজ্ঞা নেই…

"আমরা হোটেলে এসে গেছি"

ভূষণবাবু ঢেউয়ে পা ডুবিয়ে বসে। বৃষ্টিতে ভিজে সপসপ। সিগারেটের প্যাকেট… দেশলাই সব ভিজিয়ে দিয়েছেন… ইচ্ছা করেই…. কোনো প্রশ্ন জাগে না মনে…. কোনো কৌতুহলও না….. এর চাইতে ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের উপর পা রেখে বসে থাকা অনেক সুখের…. ভূষণবাবু পুরীতে ঢেউ গুনতে আসেন। প্রতিবার গুনতে গুনতে হারিয়ে ফেলেন সংখ্যা…. ধীরে ধীরে ঢেউ হয়ে যান… মনে হয় অনন্তকাল ধরে তিনি ঢেউ হয়ে আসছেন যাচ্ছেন….. ঝিম ধরে আসে….. সংখ্যা হারালেই সব উত্তর মিলে যায়….