শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, "ধ্যান করবে মনে বনে আর কোণে। ঈশ্বর চিন্তা যত লোকে কম টের পায় ততই ভালো।" আরো বলছেন, বাবু অনেক বেলায় ঘুম থেকে ওঠেন। কেন? না, মশারির মধ্যে ধ্যান করেন গভীর রাতে।
শ্রীরামকৃষ্ণের ধ্যান নিয়ে অনেক গল্প আছে। এক ধর্মসভায় গিয়ে দেখেন সব চোখ বুজে ধ্যান করছে। ঠাকুর মজার মানুষ। ফিকফিক করে হাসছেন। হাসির কারণ কী? নিজেই বলছেন পরে। বানরগুলো চুপ করে গাছে বসে থাকে। যেন ধ্যানমগ্ন। কী ভাবছে? ভাবছে, এর ওর বাড়ির কলাটা, মূলোটা। কখন চুরি করে খাওয়া যাবে। ঠাকুর হাসতে হাসতে বলছেন, তোমাদের সভার লোকজনের ধ্যান খানিক ওইরকম।
বিবেকানন্দর যে ধ্যানমগ্ন ছবিটা পাওয়া যায়, সেটার পিছনে একটা মজার গল্প আছে। উনি কীভাবে ধ্যান করতে হয় শেখাতে বসেছিলেন। ব্যস, নিজেই গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েন। তখন একজন শিষ্য ওঁর ছবিটা তুলে নেয়। এ বিদেশের ঘটনা।
সারাভারত পায়ে হেঁটে ঘুরে, প্রায় না খেয়ে, জীর্ণশরীরে এসে বিবেকানন্দ পৌঁছেছিলেন ভারতের প্রান্তে। পরলোক ভাবনার জন্য নয়। ভারতের অধঃপতনের কারণ খুঁজতে। পেয়েওছিলেন। মেয়েদের অসম্মান আর নানা কুসংস্কারে মানুষকে পায়ে দলা। বলছেন, গোটা পৃথিবীতে ভারতের মত এত উদার ধর্মীয় দর্শনও যেমন নেই, তেমন এমনভাবে মানুষের গলায় পা দিয়ে তাকে পিষে মেরে ফেলার উদাহরণও নেই।
অবশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন, মানুষের মধ্যে পূর্ণতার বোধকে জাগিয়ে তোলাই শিক্ষা। আর মানুষের মধ্যে দিব্যসত্তাকে জাগিয়ে তোলাই ধর্ম।
ভারতের নবজাগরণ বলে যদি কিছু থাকে, তা হল এই বিশাল সত্যের উপর দাঁড়িয়ে, যে মানুষের আত্মশক্তি বলে একটা শক্তি আছে, যা যে কোনো শক্তির চাইতে বলবান ও চিরস্থায়ী। রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা আর বিবেকানন্দ এই শক্তির উপরেই দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। কয়েক শতক আগে মহাপ্রভুও একই সত্যে হেঁটে রাস্তা দেখিয়েছিলেন।
ঘৃণার শক্তির চাইতে প্রেমের শক্তি বড়। স্বামীজি আজীবন প্রচার করে গেলেন। স্বামীজি ধর্ম বলতে মানুষের ধর্ম বুঝতেন। তাই রোমা রোঁলা স্বামীজির জীবনীর উপর লিখলেন, গসপেল অব ম্যানকাইন্ড।
স্বামীজির দর্শন, চিন্তা, অনুভব এক অফুরান খনি। যার থেকে দুর্ভাগ্যবশত কিছুই নিলাম না। ভান করলাম। উৎসব করলাম। কিন্তু সে চিন্তার, সে আদর্শের ভাগীদার হতে চাইলাম না। কুৎসিত সমালোচনা করলাম। ভিত্তিহীন আরোপ করলাম। কিন্তু গভীরে গিয়ে বুঝবার চেষ্টা করলাম না।
আজ এক অদ্ভুত যুগ। সোশ্যাল মিডিয়া দেখাচ্ছে কুরুচিও কেমনভাবে ব্যবসার অঙ্গ হতে পারে। ঘৃণার দাবানল কেমনভাবে অর্থনৈতিক লাভ আনতে পারে। আজ আত্মশক্তির কথা কে বলবে? আজ আত্মচর্চা মানে জিমে যাওয়া। সুগার, কোলেস্টেরল, প্রেসার, স্ট্রেস কমানো। তার দরকার আছে স্বামীজিও বারবার বলতেন, কিন্তু সেটাই সর্বস্ব নয়। নিজের বোধের কেন্দ্রকে যদি সবল না করা যায় সত্য, ভালোবাসা আর করুণায়, তবে আত্মশক্তি দিনে দিনে দুর্বল হতে থাকে। দুর্বল শরীরে সবল আত্মশক্তি তবু মূল্যবান, কিন্তু সবল শরীরে দুর্বল চিত্ত ভয়ংকর। সে রাতদিন বিভীষিকা দেখে আর দেখাতে চায়।
স্বামীজি ছিলেন। আছেন। থাকবেন। কারণ মানবিক সত্য অবিনশ্বর। তাই স্বামীজির বাণীও অবিনশ্বর।
ধ্যান চিত্তশুদ্ধ করে। বুদ্ধ শিখিয়েছিলেন। চিত্তশুদ্ধ হলে কায়মনোবাক্য সমস্ত আচরণে তার প্রমাণ মেলে। যদি না মেলে বুঝতে হবে গীতার সেই সাবধান বাণী, বাইরের সমস্ত ইন্দ্রিয় রুদ্ধ করে যদি ধ্যানের ভান করে মনে মনে যাবতীয় বৈষয়িক চিন্তায় ডুবে থাক, তবে তুমি মিথ্যাচারী। তুমি ভণ্ড।