Skip to main content

তিনি কয়েকদিন হল দল পরিবর্তন করেছেন। এবং হিসাব মত যে দলে গেলেন, সে দলে যে সুরটা বাদী সেই সুরে নিজের কথাকেও বাঁধতে সচেষ্ট হয়েছেন। কথা হল সেই দলের প্রধান সুর হল ধর্ম। তো ইনিও ধর্মের সুরেই কথা বলছেন। সে তো বলতেই হবে, সেখানে গোলমাল কিছু নেই। তিনি তো আর হঠাৎ করে কোন রাজ্যে কতদিন ধরে কত মহিলা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ জানিয়ে যাচ্ছেন চাষাবাদ নীতি নিয়ে সে কথা তুলবেন না, এতো বোঝাই যায়। 

    কিন্তু তিনি কি আদৌ হিন্দুধর্মটা বোঝেন? আজকের 'এই সময়' খবরের কাগজের প্রথম পাতা পড়ে এই নিয়ে আমার কেমন একটা খটকা লাগল। তার মতে অন্য কোনো ধর্মে যদি ভুল মন্ত্র উচ্চারণ করা হত তবে নাকি আগুন জ্বলে যেত, কিন্তু হিন্দুধর্ম বলেই নাকি এখানে জ্বলল না। “পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের এখন ভাবার সময় এসেছে”। 

    মন্ত্র ভুল উচ্চারণ করা বিধেয় নয় আমি মানি, শুধু মন্ত্র কেন কোনো তথ্যই ভুল উচ্চারণ করা বিধেয় নয়, সে কারুর জন্মস্থান হোক চাই যাই হোক। কিন্তু কথা হচ্ছে আমি যতটা হিন্দুধর্ম বুঝি সেখানে মন্ত্র থেকে মনের গুরুত্ব বেশি বলা হয়েছে। রামকৃষ্ণদেব যেমন বলতেন 'ভাবগ্রাহী’ জনাদর্ন, আরো বলতেন ঈশ্বর মন দেখেন। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, কেউ পুরো 'বাবা' ডাকতে পারে না, শুধু 'পা পা' বলে, তাতে কি বাবা রাগ করেন? তিনি কি জানেন না কাকে ডাকা হচ্ছে?

    আচ্ছা ভাবুন রামকৃষ্ণদেব কি শাস্ত্র জানতেন? তিনি তো বিধিমত পুজো পর্যন্ত করতে পারতেন না। আপনি বলবেন সবাই কি রামকৃষ্ণ? আমি বলব, ভায়া তা তো নয় অবশ্যই, কিন্তু তিনিই তো দেখিয়েছেন যে মন্ত্রের যে মনের গুরুত্ব বেশি, তাই নয় কি? নইলে উনি কেন বলেন যে হবিষ্যি অন্ন খেয়ে যদি কারোর ঈশ্বরে মন না হয় তবে সে ধিক্, আর যদি কারোর শূকরের মাংস খেয়ে ঈশ্বরে মন হয় সেই ধন্য। কই আগুন জ্বালানোর কথা তো বললেন না। যদিও আমি আবারও বলছি ভুল মন্ত্র বলার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছি না, আমি যুক্তি দিচ্ছি ভুল মন্ত্র বলার জন্য “আগুন জ্বালানোর” মত উস্কানিমূলক কথার বিরোধিতাতে। কথায় কথায় যদি আগুন জ্বলে যায়, মানে একটু ভুল মন্ত্র উচ্চারণে, তবে তো দাদা পশ্চিমবঙ্গে হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র পুরোহিত বই আর কেউ থাকবে না। ক'জন মন্ত্রের উচ্চারণ তো দূরের কথা, মন্ত্রের অর্থটিও স্পষ্ট জানেন?

    আসলে বাকি ভারতীয়দের কথা জানি না, কিন্তু আমরা তো বাঙালি, আমাদের হিন্দুধর্মটি বড় প্রেমের, ওসব শাসনের না। কেন ওই গান শোনেনি? “আমি মন্ত্র-তন্ত্র কিছুই জানি নে মা / শুধু যা জেনেছি, সেটুক হল এই / তোরে ডাকার মত ডাকতে যদি পারি / তবে আসবি নে তোর এমন সাধ্য নেই”। এ গানে তো কই আগুন জ্বালানোর কথা বলা হল না? এ তো চোখের জলের কথা বলা হল। আচ্ছা বিবেকানন্দের কথাই ধরুন, তিনি তো বলছেন জপ-তপ এসব সাধ্য-সাধন সব বুদ্ধির বিভ্রম। 'সখার প্রতি' কবিতাটায় গো, বলছেন না? উনিও বলছেন আসল কথা হল --- “জীবে প্রেম করে যেই জন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর”। তবে কি সে জপতপ করবে না?

    সে উত্তরও আছে। মানুষের দুটো ভক্তি হয়, এক বৈধীভক্তি, আর দুই রাগানুরাগ ভক্তি। এখন এই বিধিনিষেধ সব শুধু বৈধীভক্তির ক্ষেত্রে। তবে এই বৈধীভক্তির উদ্দেশ্য কি? রামকৃষ্ণদেব বলছেন, বৈধীভক্তি থেকে রাগানুরাগ ভক্তি হয়। কই উনি তো বললেন না তা দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়?

    উক্ত জনপ্রতিনিধি আরো বললেন, “প্রতিদিন গায়ত্রী উচ্চারণ করি, সূর্য প্রণাম করি”। কিন্তু জনপ্রতিনিধি হিসাবে মানবধর্ম পালন করি”। 

    এই কিন্তু শব্দটায় আমার আবার খটকা লাগল। 'মানবধর্ম' আর 'হিন্দুধর্ম' তবে এক পদবাচ্য হচ্ছে না? তবে উনি যে বললেন উনি বিবেকানন্দ পড়েছেন, কিন্তু আমি যতদূর পড়েছি বিবেকানন্দ'র শিক্ষায় তো এর মধ্যে বিভেদ ছিল না। এমনকি সেই জন্যেই হয় তো রোমা রোঁলা'র মত নোবেলজয়ী মানুষ যখন বিবেকানন্দের জীবনী লিখছেন তখন বইয়ের শিরোনামে লেখা হচ্ছে --- 'গসপেল অব ম্যানকাইণ্ড', মানবতার শাস্ত্র। কথাটা কি ভুল লিখলেন তবে? নাকি আমি ভুল বুঝলাম? আর রবীন্দ্রনাথই বা কেন তার ধর্মবিশ্বাসের উপর লেখা বইটার নাম লিখলেন ‘মানবধর্ম’? আচ্ছা বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ তো না হয় সেদিনের মানুষ, আপনি চণ্ডীদাসের মত বৈষ্ণবভক্তের কথা ভাবুন, তিনি লিখেছেন - সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। 

    শেষ করি উক্ত মাননীয় জনপ্রতিনিধির আর একটি উক্তি দিয়ে। তিনি বলছেন, “বাংলায় হিন্দুধর্মের সর্বনাশ করা হচ্ছে। ঠিক মন্ত্র শেখানোর জন্য যোগী আদিত্যনাথজির এখানে আসা দরকার”। 

    আমি আবার ঘেঁটে গেলাম। যে দেশে রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম, মহামিলন মঠ ইত্যাদি ইত্যাদি এত আশ্রম, সাধুসন্ত এত জনে আমাদের শুদ্ধমন্ত্র শেখাতে পারবেন না? আমাদের অন্য রাজ্যের মন্ত্র এনে শিখতে হবে? একি আমাদের সাধুসন্তদের অপমান না? এই যে বেলুড় মঠের এত এত অনুষ্ঠান লাইভ দেখানো হয় টিভিতে, ইউটিউবে, তা সেখান থেকেও আমরা শুদ্ধমন্ত্র শিখতে পারব না? আর যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কথা হচ্ছে সে রাজ্যে শুদ্ধমন্ত্রের চাইতে তো মনে হয় শুদ্ধ আইনে মহিলাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা আগে দরকার। আজকের পেপার খুলুন, আজকেই আরেক ভয়ংকর ঘটনার কথা আছে। যাক গে, সে কথা তো সারা বিশ্ব জানে সে নিয়ে আর নতুন করে কি বলার?

    আমার একটাই অনুরোধ সব জননেতাদের কাছে। আপনারা শুধু এই ধর্ম আর আগুন জ্বালানোর কথাটা একসঙ্গে উচ্চারণ করবেন না প্লিজ। আমাদের বাংলার মাটি ধর্ম বলতে কীর্তন বোঝে, শ্যামাসঙ্গীত বোঝে, কথামৃত বোঝে, ঠাকুর-মা-স্বামীজি, রামঠাকুর, ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, অনুকূল ঠাকুর, নিগমানন্দজী প্রমুখদের বোঝেন। তারা কেউ ভুল মন্ত্র উচ্চারণে আগুন লাগানোর শিক্ষা দেননি। আপনারা অনুগ্রহ করে এই নোংরামিটা করবেন না।