রাত হয়েছে বেশ। আমি মাকে নিয়ে ভেলোরে, CMC তে চেক-আপে গেছি। দুদিন হল এসেছি। সারাদিন নানা পরীক্ষানিরীক্ষার ধকলে মা ক্লান্ত, হোটেলের ঘরে শুয়ে। আমি এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হসপিটালের কেন্দ্রে যে চার্চটা, সেই চার্চে এসে বসেছি। বেশ বড় চার্চ, চারদিকে চারটে দরজা। সারসার বেঞ্চ। সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। সামনে দেওয়ালে যীশুর ক্রস। চারদিক অন্ধকার আলো মেশানো। চার্চের ভেতরটাতেও একটা হালকা আলো জ্বলছে। আমি গিয়ে একটা বেঞ্চে বসলাম। খানিক ক্লান্তিতে, খানিক অবসাদে। জানি তো যে লড়াইয়ে নেমেছি এ অসম লড়াই। হেরে যাব। যে মানুষটা ক্লান্ত শরীরে হোটেলের ঘরে শুয়ে, তার যাত্রা নিশ্চিত, তারিখটা জানি না।
সমস্ত বিজ্ঞানের সত্যকে মিথ্যা করে এক মহান ঈশ্বর আমার মায়ের জন্য কিছু একটা মির্যাকেল ঘটাবেন এমন প্রত্যাশা নেই, তবু মনে হচ্ছিল সব কিছু যদি মিথ্যা হয়ে যায়! একটা গান মনে পড়ছিল, "জেনেছি জেনেছি তারা, জেনেছি তোর ভোজের বাজি... যে তোমায় যে নামে ডাকে তাতে তুমি হও মা রাজী...."
এ গানে একটা লাইন আছে, "গড বলে ফিরিঙ্গি যারা.... খোদা বলে ডাকে তোমায় মোগল পাঠান সৈয়দ কাজী..."
হঠাৎ এই গানটা মনে এল কেন? মায়ের কথা ভাবছি বলে? হয় তো তাই। অধ্যাত্ম জগতে মৃত্যু নাই। মানু্ষের আশার মত। স্বপ্নের মত। কল্পনার মত। এসবেরও তো মৃত্যু নাই। "ঈশা মুশা শ্রীচৈতন্য, প্রেমের ভরে অচৈতন্য...", 'ব্রহ্মময়ী দে মা পাগল করে'... গানের লাইন। ভেদকে 'বৈচিত্র্য' বলেছে, 'বৈপরীত্য' বলেছে এমন তো শুনিনি। এমন তো বিশ্বাসও হয় না কেউ বলেছে বলে। অধ্যত্ম জগতে তুলনা হয় না। অসীমের স্বভাবে 'তুলনা' শব্দের অস্তিত্ব কোথায়? সব ধর্মের বিষয়ই তো অসীম, অনন্ত আর অমরত্ব নিয়ে। তবে আর তুলনা হবে কার সাথে কার? অসীম আর অনন্ত তো দুটি হতে পারে না।
আসলে কথাটা ধর্ম না, রুচি নিয়ে। রুচির ভেদ স্বীকার করতে হয়, কিন্তু সে তো শুধু শৌখিনতার সময়। ঘরে আগুন লাগলে কি আর পছন্দের পাত্র হাতে, পছন্দের জলাশয় নিয়ে তর্ক চলে? তখন শুধুই জলের প্রয়োজন। সে জল হল শান্তি। ধর্ম যখন অশান্তির কারণ হয়, তখন বুঝতে হবে ওটা নকল শব্দ। আসল বস্তুটা থেকে অনেক দূরে। শান্তির প্রবর্তকেরা হঠাৎ করে বৈচিত্র্যকে বৈপরীত্য বলে চালাতে চাইছেই বা কেন হঠাৎ?
সেদিন মনে হচ্ছিল এই গানগুলোর মধ্যে দিয়ে পদকর্তাদের সংহতি স্থাপনের আকুতির কথা। কত বড় প্রাণ মানুষগুলোর ছিল, না? হবে নাই বা কেন, মতলব ছিল না যে। হঠাৎ একজন মহিলা সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি চমকেই উঠেছিলাম খানিক ওনাকে দেখে। আসলে চার্চের ভেতরটা এত অন্ধকার ছিল যে আমি খেয়ালই করিনি। তাছাড়া নিজের অন্যমনষ্কতা তো ছিলই।
বেশ বয়েস হয়েছে ওনার। মুখটা ভীষণ প্রসন্ন। আমি যেখানে বসে সেখানে পিছনের দরজা দিয়ে আলো এসে পড়েছিল। সে আলোতে ওর মুখটা যে কি সুন্দর লাগছিল! যেন কি একটা আশ্বাস উনি পেয়েছেন জীবনে। অথবা এত কিছু হারিয়েছেন যে আর নতুন করে কিছু হারাবার ভয় যেন নেই। আমার দিকে তাকিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন তামিলে। বললাম, আমি বুঝি না তামিল। উনি তখন ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে জিজ্ঞাসা করলেন, এত রাতে কার জন্য প্রার্থনা করতে এসেছ?
বললাম, মায়ের জন্য। বলতে পেরে ভালো লাগল। যেন নিজের উদ্বিগ্নতার কথা কাউকে অন্তত বলার পেলাম। হতাশাকে রাখার জন্যও একটা পাত্র তো লাগে।
তিনি স্মিত হেসে বললেন, ঠিক হো জায়েগি....
আমার দিকে চেয়ে থাকলেন খানিকক্ষণ। তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চার্চের দরজা দিয়ে বাইরে চলে গেলেন।
আমি জানি এ প্রবোধ। এ মিথ্যা। তবু ওই সময়টুকুর জন্য আমার ভালো লাগল। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করল। না হয় হলই অলৌকিক কিছু।
চার্চ থেকে বেরিয়ে হাসপাতালের কম্পাউন্ড দিয়ে হাঁটছি। যতদূর চোখ যায় হাসপাতালের বিল্ডিং আর বিল্ডিং। হাজার হাজার রুগী। সারা ভারত থেকে আসা রুগী। কোনোটাই সহজ সরল রোগ তো নয়, সে নিয়ে কি কেউ আসে এদ্দূর! তবে?
অলৌকিক ঘটনা না ঘটুক। অলৌকিক ভালোবাসাটুকু আস্থাটুকু থাকুক। সামনে অনেক বড় লড়াই যে। যে মানুষটা ক্রুশবিদ্ধ, যার সামনে বসে ছিলাম, যার সামনে কোটি কোটি মানুষ নত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে, সে নিজের মৃত্যুকে কি ঠেকাতে পেরেছিল? পেরেছিল বিশ্বাসঘাতকতার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে? পারে নি। কেউই পারে না। তিনি অন্ধকে চোখ দিয়েছেন, পঙ্গুকে হাঁটার শক্তি দিয়েছেন, সেটা বড় কথা নয়, মৃত্যুর পরের আবির্ভাবও তুচ্ছ কথা। ক্রুশ অবধি স্বেচ্ছায় পৌঁছানো যায়, এইটেই সব চাইতে বড় কথা। প্রতিটা পেরেক, প্রতিটা উপহাস ক্রুশে বিদ্ধ হতে হতে সহ্য করা যায়, এইটা খুব বড় কথা। নিজে না পারলেও, অভিযোগ জানাতে অন্তত লজ্জা হবে নিজের ভাগ্যের প্রতিকূলতা নিয়ে - এইটুকুই আমার লাভ।
পরে একবার এক ফাদার আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন খ্রীষ্ট নিয়ে এমন বোধ জন্মালো কি করে। গর্বের সাথে বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী আর বিবেকানন্দ পড়ে। 'একং সত, বিপ্র বহুধা বদন্তি...' সত্য এক, ব্যাখ্যা অনেক - এই উপনিষদের বিশ্বাস থেকে।
কিন্তু আজ কি সে কথা বলতে কোথাও একটা খোঁচা লাগবে না বুকে? কারা যেন ভুলিয়ে দিতে চাইছে ইতিহাস। বাংলাদেশ পাকিস্তান ভেঙে ভারত হয়নি, ভারত ভেঙে প্রতিবেশী দেশ জন্মেছিল। উৎসটা একই। ভারত বর্জন করে ভারত হয়নি, গ্রহণ করে মহৎ হয়েছে। রামচরিত মানসে আছে, শরণাগতকে যে নিজের স্বার্থের জন্য দূরে ঠেলে সে অধর্মী। তাকে আশ্রয় দেওয়াই সজ্জনের কাজ - জাতিধর্মনির্বিশেষে।
সৌরভ ভট্টাচার্য
25 December 2019