শ্রাদ্ধের মন্ত্রোচ্চারণ হচ্ছে। অমল স্পষ্ট দেখল মা আসছে। কাঁধে একটা কাক। মা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। উঠানে ধুনো ধুপ জ্বালানো। গীতা পাঠ করছে পোস্টমাস্টারের দাদা। তিনশো টাকা নেবে। ধুপের ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা, সেই জ্বালায় অমল দেখছে মা দাঁড়িয়ে সামনে। হঠাৎ কাকটাকে কাঁধ থেকে উড়িয়ে দিয়ে, মা বলল, যা!
কাকটা উড়ে এসে পিণ্ডিতে ঠোক্কর দিল। টালির চালের উপর উড়ে গিয়ে বসল। আবার নামল। আবার পিণ্ডিতে ঠোক্কর দিল। সবাই বলল, ওই দেখো অমল, মা এসেছে তোমার, কাক হয়ে।
অমলের মা আজকের থেকে ঠিক বারো বছর চারমাস আগে হারিয়ে গিয়েছিল। আজও পাওয়া যায়নি। সবাই বলল, অমল এবার একটা শ্রাদ্ধ করে ফেলো হে। অমল তাই করে ফেলল। পাঁজি দেখে। কেউ পাঁজি দেখে হারায় না, মরে না, জন্মায় না। তবু মানুষ পাঁজি দেখে সবার যাওয়া আসার মানে বুঝে যায়। বুঝিয়ে দেয়।
অমল দেখল, মা নেই। ধোঁয়া আছে। কাকটা আছে। টালির চালের উপর।
=======
“ও এঁটো মেয়েমানুষ নিয়ে কী করবি যতীন? থাক, ও যেমন গেছে জাতধম্ম খুইয়ে! মরুক গে।”
যতীন পুকুরের ধারে বসে। দূরে অমলদার বাড়ির থেকে শ্রাদ্ধের মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যাচ্ছে। কাকটা এঁটো মুখে সামনের পেঁপে গাছটার উপর বসে।
যতীন গলার কণ্ঠিটায় হাত বুলালো। বড় ছেলেটার বয়েস আট। ছোটোটার বয়েস তিন। অন্তত ওদের দিকে তাকিয়ে ফিরুক।
যতীনের চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। শ্রাদ্ধের মন্ত্র আরো উতলা করে দিচ্ছে। এ মন্ত্র বহুবার শুনেছে। বাবা, মা, দাদা। সব গেল। তাই বলে অতসী! পালিয়ে যাবে!
যতীন অমলদার বাড়ির দিকে তাকালো। দুজনেই মিস্ত্রির কাজ করে। অভাব তেমন নেই। মাঝেমধ্যে টানাটানি হয়। আবার ঠিক হয়ে যায়।
পাশে বসে অনন্ত। ভ্যান চালায়। অনন্ত দূর সম্পর্কের কাকা হয়। এমন কিছু বড় যে তা নয়। যতীন “তুমি” করে বলে।
“তুইও বারো বছর হলে… বারো বছর কেন, বারোদিন হলে ওর নামে শ্রাদ্ধ করে দিস। দরকার নেই ঘরে তোলার, যদি ফেরে সে মাগী।” অনন্ত পুকুরের ধারে আধশোয়া হয়ে বলল। ভালো লাগছে অনন্তর, অনেকদিন পর নতুন স্বাদের কথা বলতে পেরে ভালো লাগছে। নইলে সব কেমন একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছিল। একটা আরাম লাগছে। যদিও এ আরামটা অন্যায় জানে অনন্ত। তবু। সুখ এলে সে ন্যায় ডিঙিয়েই আসে সংসারে। নইলে অতসী পালাতে যাবে কেন? বেশ করেছে।
আচ্ছা কাকা, যদি অমলদার মা ফিরে আসে হঠাৎ… তারপর সত্যি সত্যিই মারা যায়। আবার শ্রাদ্ধ হবে? কবার মরে একটা মানুষ?
অনন্তের মৃত্যুর কথা ভালো লাগছে না শুনতে। এই তো সবে একটা বিষয়ে সে মজেছে। এখন এ সব কথা কেন?
অনন্ত বলল, ভাগ! ও বুড়ি মরেছে…
=====
কাকটা আবার ফিরে এসেছে। শ্রাদ্ধ শেষের দিকে। অমলের কান্না পাচ্ছে না। অধৈর্য লাগছে। পাড়ায় যতীনের বউকে নিয়ে খুব চর্চা হচ্ছে। পুলিশ এসেছিল। যতীন কাঁদছে। সবাই বলছে, শালা এমন ম্যাদাটে পুরুষ দেখিনি কেউ।
যতীনের কাঁদা উচিত কিনা বোঝে না অমল। তার বউ ময়না সবাইকে চা দিচ্ছে। যদি চলে যায়? কাঁদবে অমল?
পুরোহিত বলল, হল বুঝলে। এবার উঠে কিছু মুখে দাও। বউমা… অমলকে একটু ছাতুর সরবত দাও।
অমল বলল, আচ্ছা দাদা, মা যদি ফিরে আসে?
নাকে নস্যি নিয়ে, তিনটে হাঁচি দিয়ে বলল নরেশ, ও ফিরবে না। আমি শ্রাদ্ধ করতে গিয়ে সব বুঝতে পারি। তোমার মায়ের আত্মা এসে আমাকে আশীর্বাদ করে গেল। ভালো গতিই হয়েছে।
অমল ছাতুর সরবতটা নিয়ে রাস্তায় এলো। পুরোহিত খাবে এখন। যতীন পুকুরের ধারে শুয়ে। ওকে নিয়ে ভয় করে। অনন্তটাও যা মাল একটা!
অমল যতীনের পাশে বসে বলল, ভাবিস না। এলে আবার নিয়ে নিস। না খেয়ে খেয়ে শরীরটা এই কদিনেই কি করেছিস?
যতীন অবাক হল। এইটা কারোর চোখে পড়ছে না? সে যে শুকিয়ে যাচ্ছে, রাতে ঘুম নেই, দিনে খাওয়া, স্নান নেই, কারোর চোখে পড়ছে না? মানুষ এত অন্ধ!
অনন্ত নাক ডাকছে। অমল আর যতীন পাশাপাশি বসে পুকুরের ধারে। কেউ কোনো কথা বলছে না। দুজনেই যেন দুজনের হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ, শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ অনুভব করতে পারছে। বড় পুকুর। ওপারে হোগলার বন। দুজনের চোখ সেদিকে। তাদের ভাবনাগুলো ধোঁয়ার মত হোগলার বন অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে। উদাসীন চোখে তাকিয়ে দুজনে….. সে বন-জঙ্গল পেরিয়ে কে যেন চলে যাচ্ছে দূরে, না কাছে আসছে?