এই যে তাকিয়ে দেখা। এর কোনো মানে নেই। কোনো উদ্দেশ্য নেই। তাকিয়ে আছি, মানে কেবলই তাকিয়েই আছি।
তাকিয়ে থাকা মানেই কি প্রকৃতি দেখছি? না না। সে সুযোগ অনেক কম। চারদিকে বাড়ি। পাঁচিল। দেওয়াল। কৃত্রিম রং। তার ফাঁকে ফাঁকেই ছোটো ছোটো বাগান। কয়েকটা বড় গাছ। হাতে গোনা। সেখানেই কাক, চড়াই, পিঁপড়ে, কেন্নো, কেঁচো, দোয়েল, খঞ্জনা, হাঁড়িচাচা, শালিখ, টুনটুনি। আর আছে আকাশ। দুটো বাড়ির ফাঁক দিয়ে দেখা আকাশ। ছাদ আছে। যাওয়ার অবসর হয় কই? সময় কালেভদ্রে হয়।
তবু তাকিয়ে থাকার এক নেশা আছে। কাজের মধ্যে। এক খণ্ড অবসর পেলে আমি তাকিয়ে থাকতে থাকতে আশ্চর্য হই। বেড়াল, কুকুর থেকে শুরু করে গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ সব দেখেই আশ্চর্য হই। মুগ্ধ হই। দেওয়ালের উপর এসে রোদ পড়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদ হাঁটে। ছায়া হয়। ছায়া গড়ায়। মেঘ জমে। বৃষ্টি হয়। জল জমে। আবার সব শুকিয়ে যায়। সব দেখি। এসবের কোনো মানে হয় না। তবু দেখি। দেখতে দেখতে নিজেকে কি তুচ্ছ মনে হয়। মনে হয় এই যে কালের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা অংশে আমি আছি, এ তো প্রতিদিন আমার থেকে অল্প অল্প সরে যাচ্ছে। প্রতিদিন অল্প অল্প করে ফুরিয়ে যাচ্ছি আমি। কিন্তু যা জমছে ভিতরে, সে যেন নির্বিশেষ হয়েও বিশেষ একটা কিছু।
এই যে এত এত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হওয়া, তাদের কথা শোনা, যারা কেউই কোনো অর্থে সেলিব্রিটি নয়, আমারই মত অতি সাধারণ, তাদের জীবনগুলোর কয়েকটা অধ্যায় যখন পড়ি, জানি, শুনি…. আশ্চর্য হই। সুখ, দু:খ, আনন্দ, শোক, মান, অপমান, সবই তো দেখি জানাশোনা…. আমি যেমন পেয়েছি, তারাও পেয়েছে….. কোথাও কোনো পার্থক্য নেই…. সব একই। সুরের তারতম্য আছে। স্বরের নেই।
যা দেখছি, তা অমূল্য। যা শুনছি, তা অমূল্য। কোনো মূহূর্তই গ্র্যান্টেড নয়। কোনো ক্ষণই আমি এমনি এমনি কাটিয়ে যেতে চাই তা নয়। আমি প্রতিটা ক্ষণে সম্পূর্ণভাবে উপস্থিত থাকতে চাই। আমার চেতনা যতক্ষণ জেগে থাকে, যা-ই আসুক, আমি তা-ই সাদরে গ্রহণ করতে চাই। তারাই আমাকে পূর্ণ করবে। কোনো কৃত্রিম পূর্ণতাবোধের আশ্বাস নিয়ে, কি হাইপোথিসিস নিয়ে আমি বাঁচতে নারাজ। আমি তো বলছি না আমাকে সুখই দাও, সফলতাই দাও…. দু:খ, শোক পেয়েছি তো! প্রাণের চাইতে প্রিয় মানুষের মৃত্যুশোক পেয়েছি…. যে পরে এসেছে তাকেও তো বিদায় জানিয়েছি…. তবু বলতে চাই, এই শোকই আমার আমিকে উজ্জ্বল করেছে। দীন করেনি। আমি অভিযোগের খাতা নিয়ে দরজায় দরজায় ফিরতে চাই না। ওতেই নিজেকে বড্ড দীন মনে হয়।
অপমানিতও হয়েছি। বহুভাবে বহুবার হয়েছি। কিন্তু বিষ জমিয়ে রেখে, তার ক্ষতি চেয়ে দিনযাপন করতে হয়নি। ভিজে কাপড় অত্যন্ত মেঘলা দিনেও মেলে রাখতে রাখতে যেমন শুকিয়ে যায়, মনের ভিতর থেকে সব মালিন্য শুকিয়ে ঝরে গেছে। শুধু সময় লেগেছে। তারপর সেই অপমানকারী যখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, মনের ভিতর থেকে এক গভীর নিস্পৃহতা অনুভব করেছি। রাগ নয়। আক্রোশ নয়। শুধুই নিস্পৃহতা। নির্লিপ্ততা।
তাকিয়ে দেখি কেবল। চোখ ক্লান্ত হলে কান খাঁড়া করে শুনি। চোখ কান ক্লান্ত হলে নিজের মধ্যে ডুবে হাজার মানুষের সুখদুখের কথা শুনি। স্মৃতিতে কত কত মানুষের কথা। তাদের দেখি। জীবনে কোনো না কোনো সময়ে তারা কোনো না কোনো সম্পর্কে ছিল। আজ অনেকে নেই। যারা গেছে তাদের কথা ভাবি। ভাবতে ভাবতে সময়ের বেড়া টপকে যাই। এমনকি যাদের কথা বইতে পড়েছি তারা স্পষ্ট হয়। ইতিহাস সামনে এসে দাঁড়ায়। কথা বলে। বর্তমান কালের সীমাবদ্ধতা অসীম অতীতের মধ্যে লীন হয়। কত কিছু স্পষ্ট হয়। ইতিহাস মানে শুধু যুদ্ধ আর রাজার গল্প তো নয়, ইতিহাস মানে অভিব্যক্তির রাস্তাও তো। মানুষের ইতিহাস কি অতই এক কি দুই মাত্রিক?
এরপর আসে সে-ই পরিত্রাণকারী উদাসীনতা। সবের মধ্যে থেকেও কিছুর মধ্যে না থাকার মাধুরী। কোনো কিছুর অতিলৌকিক ব্যাখ্যা নয়। কোনো পাপ-পুণ্যের হিসাব নয়। কোনো অভাব অভিযোগ নয়। শুধু উদাসীনতা। নিটোল উদাসীনতা। এই যে নিত্য অল্প অল্প ফুরিয়ে যাচ্ছি তার দিকে তাকিয়ে দেখা। নিজেকে প্রস্তুত করা। নতজানু হয়ে এই অসীম অনন্ত রহস্যময় সৃষ্টিকে প্রণাম জানানো, বলা, ধন্য… ধন্য…. ধন্য…. ব্যস, আর কিছু বলার নেই।