রাস্তাটা পেরোলেই দোকান। পরিতোষ তাও যেতে পারছে না। ওর পা যেন কিসে আটকে ধরেছে। কোমর থেকে পায়ের পাতা অবধি ছিঁড়ে যাচ্ছে ব্যাথায়। তবু এক প্যাকেট সিগারেট না হলে চলছেই না।
ঘড়ি দেখল। সন্ধ্যে সাতটা। আর কিছুক্ষণ বাইরে থাকা যাবে। তারপর ঢুকে যেতে হবে হোটেলে। যা ঠাণ্ডা!
- আপনার কাছে দেশলাই হবে? পরিতোষের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল? হবে হয় তো।
পরিতোষ জানে ওর পকেটে দেশলাই আছে। তাতে চারটে কাঠি আছে। এই পাহাড়ি গ্রামে এই সামনের দোকানটাই সম্বল। কাল দেশলাই ছিল না। আজ সকালে এনে দিয়েছে অনেক নীচে নেমে শহর থেকে। আজও যদি সেরকম কিছু একটা হয়!
- না স্যার দেশলাই হবে না।
লোকটার মুখটা এতক্ষণ খেয়াল করেনি পরিতোষ। এবার করল। তার থেকে বছর দশেকের মত বড় হবে, আন্দাজ বিয়াল্লিশ, পঁয়তাল্লিশ পেরোয়নি, সিওর। সারা মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। মুখে কোনো সস্তা মদের গন্ধ। এই পাহাড়ি গ্রামে এটা অবশ্য অস্বাভাবিক না। সব্বাই খায়। দেখে গোর্খাই মনে হচ্ছে। পরনে একটা সবুজ রঙের জ্যাকেট, একটা নীল জিন্স, শতচ্ছিন্ন। পায়ে একটা হাওয়াই চটি।
লোকটা তীক্ষ্ম নজরে পরিতোষের মুখের দিকে তাকাল। এই গ্রামটার রাস্তায় মাত্র চারটে কি পাঁচটা স্ট্রীট লাইট। তাতে খুব একটা জোরালো ভোল্টেজও নেই।
পরিতোষের কেমন অস্বস্তি লাগতে লাগল। লোকটা বলল, নেই, না? এত ভাল বাংলা বলছে কি করে? যাক গে। সে কিছুটা লোকটাকে এড়িয়ে যাবে বলেই জোর করে পা চালিয়ে এ পারে এলো। এসেই পিছন ফিরে একবার তাকাল। লোকটা ঠায় দাঁড়িয়ে। তারই দিকে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে তো।
যাক গে, সাইকো মাল হবে। এই গ্রামে এটা নিয়ে তার তিনদিন। অফিসের কাজে। একটা প্রজেক্ট হবে পাশের পাহাড়টায়। তার জন্য কিছু তথ্য জোগাড়ের কাজ তার। আর কিছু পারমিশান করানোর তাগাদা দিয়ে যাওয়া। সে এই কাজগুলো বেশ সময় নিয়ে করে। তাতে বেড়ানোও হয়, আর রেস্টও হয়। এমনিতে ব্যাচেলার হওয়ায় কোনো পিছুটানও নেই। বাবা মায়ের পাট তো সেই ছেলেবেলায় চুকে গেছে।
- দাদা সিগারেট আছে?
- কোনটা?
পরিতোষ নামটা বলে আরেকবার পিছনের দিকে তাকাল। নাহ্, লোকটা তো জ্বালালে দেখছি! এখনো এদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে।
- আচ্ছা দেশলাই আছে দাদা?
- আছে।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল পরিতোষ। যাক লোকটার পিছু ছাড়ানো যাবে।
দেশলাই আর সিগারেট কিনে ফিরতে গিয়ে মনে পড়ল, আরে পায়ের ব্যাথাটার কথা তো মনেই ছিল না! উফ্..., মনে পড়তেই আবার টনটনিয়ে উঠল জায়গাটা।
আরে একি! এ পারে এসে দেখে কেউ নেই, গেল কোথায় লোকটা? এদিক ওদিক দু'পা হেঁটে দেখে আসল। নেই। আশ্চর্য তো!
২
---
হোটেলের ঘরে ঢুকে লেপের তলায় ঢুকে গেল। ঠিক হোটেল না যদিও। ওই হোটেল আর হোম স্টে এর মাঝামাঝি। একটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করল। আলোটা খুব অল্প। তবু ওর রোজ রাতে শুতে যাওয়ার আগে বই পড়ার নেশা। কয়েক পাতা না হলে তার ঘুমই আসবে না।
যা হোক অল্প আলোর জন্যই হোক, আর ব্যাথার জন্যেই হোক। খুব তাড়াতাড়ি ঘুম ঘুম পেতে লাগল। উঠে টয়লেটের দিকে যেতে যাবে, দেখে জানলার কাছে থেকে কেমন একটা বিড়ির গন্ধ আসছে। এত রাতে বিড়ি কে খাবে? তাও এত ঠাণ্ডায় বাইরে দাঁড়িয়ে। খুব আশ্চর্য লাগল। যা হোক টয়লেট করে আবার বিছানায় বডি ফেলে বলল, আহ্! আলো নিভাতে গিয়ে হঠাৎ তার মনে হল, আচ্ছা গন্ধটা ঢুকবে কি করে? সব জানলাই তো কাঁচ দেওয়া, বন্ধ, তবে?
যা হোক, সে সব নিয়ে মাথা ঘামানোর মত শক্তিও নেই তার।
ঘুমিয়েই পড়েছিল। আচমকা নাকে বিড়ির তীব্র গন্ধ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল। আলো জ্বালালো। তবে কি কিছু পুড়ছে ঘরের ভিতরে? না তো!
অথচ গন্ধটা খুব অস্বস্তিকর। একবার ভাবল বাইরে যাবে। তারপর ভাবল, না থাক, যা ঠাণ্ডা বাইরে! তার ওপর পায়ের রেস্টও দরকার আজ। পাহাড়ে আচমকাই হোঁচট খেয়ে পড়ে এই বিপত্তি। নিজের পায়ে দু'বার হাত বুলিয়ে দেখল ব্যাথা লাগছে কি না। না, লাগছে না। ফোলেও নি যদিও। কাল ব্যাথা থাকলে একটা পেন কিলার আনিয়ে নেবে না হয়।
আলো নিভিয়ে শুতে গেল, হঠাৎ মনে হল কি একটা ছায়ার মত তার পাশ থেকে সরে গেল। তার সারা শরীর সিরসির করে উঠল আচমকাই। সাথে সাথেই আলো জ্বালালো। নাহ্, কেউ তো না। তবে?
আবার আলো নিভাল। চোখ বন্ধ করেই মনে হচ্ছে, কে যেন একটা মাথার কাছে দাঁড়িয়ে। খুব অস্বস্তি লাগল। মোবাইলটা অন করল। নেটওয়ার্ক নেই। ঘরের মধ্যে থাকে না। বাইরে যাও বা থাকে। ভিতরে আসে যায়। তা প্রায় আসে না বললেই চলে।
মোবাইল ঘেঁটে গান চালাতে যাবে, সেটটা হ্যাং করে গেল। কি যে প্রচণ্ড বিরক্তিকর লাগে মাঝে মাঝে এই স্মার্টফোনগুলো! যা হোক চোখ বন্ধ করে জোর করেই ঘুমাতে চেষ্টা করল।
হাতে কি একটা ঠেকল! ধড়মড় করে উঠে বসল। আলো জ্বালতে গিয়ে বুঝল লোডশেডিং। তার ঘাম হতে শুরু করল। স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার সামনে জানলার ধারে কেউ দাঁড়িয়ে। ছায়ার মত। তারই দিকে মুখ। চাঁদের আলোয় পর্দাটা যেটুকু ফাঁক হয়ে আছে, দেখতে পাচ্ছে গায়ে একটা সবুজ সবুজ জ্যাকেট যেন।
সে কিছু বোঝার আগেই, খ্যানখেনে গলা ভেসে এলো, দেশলাইটা একটু নেব?