২০১১ সালের মারাঠি সিনেমা, দেউল (Deool)। জাতীয় পুরষ্কার পায়, শ্রেষ্ঠ চলচিত্র, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ বিভাগে।
pk নিয়ে যত আলোচনা হয়েছিল, অবশ্যই এই সিনেমাটা নিয়ে তত আলোচনা জাতীয় স্তরে সম্ভব নয়, কারণ এটা মারাঠি মুভি। মহারাষ্ট্রের ভাষা মারাঠি, এই জন্যেই এ কথাটা বিশেষভাবে উল্লেখ করছি, কারণ এই ভাষাটা যে রাজ্যে বলা হয়ে থাকে, আমাদের দেশের সবচাইতে জনপ্রিয় স্টুডিও ‘বলিউড’-ও সেই একই রাজ্যে আছে। সেখানে যে ভাষায় সিনেমা হয়ে থাকে, সেই ভাষাটা সেই রাজ্যেরও না। আমরা যেমন মনে করে থাকি ভারতে মোটামুটি কয়েকটা ভাষা আছে, বাংলা, বাংলার মত অসমীয়া, দক্ষিণ ভারতীয়, পাঞ্জাবী, উড়িয়া আর বাকি সব হিন্দি। আর কিছু হল্ট স্টেশানের মত ছুটকা ছাটকা ভাষা মণিপুরী, নেপালী ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর সারা ভারত জুড়ে বেড়াতে বা কাজে গিয়ে যখন একে তাকে জিজ্ঞাসা করি, ‘পানি কা বটল কিতনে কা হ্যায়?'... ‘টয়লেট কিধার?’... ’ইস স্টেশান মে ফলানে জানে বালি গাড়ি রুকতি হ্যায়?’... ’ইহা নর্থ ইন্ডিয়ান ফুড কাহা মিলতা হ্যায়?’ - এগুলো আমরা কি ভাষায় বলছি? কোন রাজ্যের ভাষা? জানা নেই। আসলে আমরা বলিউডের ভাষা বলছি, যেটাকে আমরা হিন্দি বলছি। কোনো রাজ্যের ভাষাই সেটা নয় আদতে। এমনকি যে ভাষায় সিনেমা, সিরিয়াল আর গান দেখেশুনে আমরা সারা ভারতে সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করি, সেই সিরিয়াল আর সিনেমার আঁতুর ঘর যে রাজ্যে সেই রাজ্যেও সম্পূর্ণ পৃথক স্বাধীন এক ভাষাতে বেশ উন্নত মানের সিনেমা হয়। সেটা অবশ্যই হিন্দি নয়, সেটা মারাঠি।
যা হোক, সিনেমাটার নাম 'দেউল'। মহারাষ্ট্রের কোনো এক অজ গ্রামের এক নিরক্ষর সরল মানুষ গরু চরাতে গিয়ে দেখে, যে গাছের ছায়ায় সে শুয়ে আছে, সেই গাছটা আসলে গাছ নয়, দত্তাত্রেয়; মানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের ত্রিমূর্তি, মহারাষ্ট্রে ভীষণভাবে লোকপ্রিয়। সে স্বপ্নে দেখে অবশ্যই। ব্যস, আর যায় কোথায়, সারা গ্রাম রাষ্ট্র হয়ে গেল যে গ্রামে দত্তাত্রেয় এসেছেন। কি হবে? মন্দির হবে। গ্রামের এক শিক্ষিত মানুষ গ্রামের প্রধানের সাথে কথা বলে একটা গ্রামীণ হাস্পাতালের মডেল ইতিমধ্যে তৈরি করে ফেলেছিলেন, টাকা-পয়সাও সরকার থেকে মঞ্জুর হয়ে প্রায় গিয়েছিল, একটা স্কুলের প্ল্যানও মঞ্জুর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হল না। হাস্পাতালের জায়গায় তৈরি হল কোটি টাকার মন্দির। স্কুলের জায়গায় তৈরি হল তীর্থযাত্রীদের জন্য হোটেল। হবে না? সারা মহারাষ্ট্র থেকে ভক্তের ঢল ভেঙে পড়ছে তো গ্রামে। ধীরে ধীরে গ্রামের চেহারা ফিরতে লাগল। মানুষ ক্রমে ক্রমে অসৎ হতে শুরু করল। এমনকি প্রসিদ্ধ ডাকাতেরও নাকি মনস্কামনা দত্তা পূরণ করে দেয়, ডাকাতি ব্যর্থ হয় না। রাজনীতি ফুলেফেঁপে উঠল এই মন্দিরকে ঘিরে। সাথে আরো নানা নেশা, ব্যবসা ইত্যাদি ইত্যাদি।
মোহভঙ্গ হতে শুরু করল সেই সরল মানুষটার যে দত্তাকে স্বপ্নে দেখেছিল। ইতিমধ্যে গ্রামের যে মানুষটাকে সে সবচাইতে শ্রদ্ধা করত, ভালোবাসত সেই শিক্ষিত মানুষ আন্না গ্রাম ছেড়ে ব্যাঙ্গালোরে তার ছেলের কাছে চলে গেছে। কি করবে থেকে? তার ইচ্ছা ছিল গ্রামে স্কুল-হাস্পাতাল হবে। আর সহ্য হল না এই ভণ্ডামি সেই সরল নিরক্ষর মানুষটার, একদিন রাতে চুরি করল দত্তাকে। তাকে নিয়ে জঙ্গল, নদী, পাহাড় --- দুর্গম জায়গায় পালিয়ে পালিয়ে বেড়ালো। দত্তাকে বলল, “হল তো শিক্ষা? কেন যেখানে সেখানে মানুষকে দেখা দিতে হবে তোমায়? নিজের মত স্বাধীন থাকো, দেখা দিলেই তোমাকে আবার এরা চার দেওয়ালে গেঁথে, সামনে লোহার গ্রিল দিয়ে কারাগারে আটকে রাখবে, ভালো লাগবে? যে শিক্ষা পেলে আর ভুলো না, বুঝেছ?”
অসামান্য সিনেমা। যেমন সিনেমাটোগ্রাফি, যেমন অভিনয়, যেমন সংলাপ তা দীর্ঘদিন মনে রাখার মত। অবশ্যই বক্তব্য বলার ভঙ্গিটা সরস, কিন্তু বিঁধবে। ঈশ্বর থেকে কি করে ব্যবসা হয় সে ভজনের কথাগুলো দীর্ঘদিন মনে থেকে যাবে। দেখে ফেলতে পারেন, আমি আমাজন প্রাইমে দেখলাম, imdb rating 8.2। যদিও সেটা খুব বড় কথা নয়, তবু অনেককে অনুপ্রাণিত করে, তাই বলে রাখলাম। dna পত্রিকা রিভিউ লিখতে গিয়ে লিখেছিল, For god's sake, don't miss 'Deool' আমারও তাই বক্তব্য, সম্ভব হলে দেখে ফেলুন।